আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট
ইতিহাসের পাতায় এমন কিছু মানুষ রয়েছেন, যাদের জীবন যেন কেবল রক্ত আর যুদ্ধের গল্প নয়—তা যেন এক মানবিক কাব্য, এক চিরন্তন অনুপ্রেরণা। তাদের মধ্যেই একজন হলেন আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট।
মাত্র ২০ বছর বয়সে তিনি যে দায়িত্ব কাঁধে নেন, তা কেবল একজন তরুণ রাজপুত্রের পক্ষে নয়—একজন মানুষের পক্ষেই ধারণ করা কঠিন। কিন্তু তিনি পেরেছিলেন। কী অসম্ভব সাহস, কী অদ্ভুত উদ্যম! গ্রীস থেকে শুরু করে ভারত পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছিল তাঁর বিজয়ের পদধ্বনি। কিন্তু তার চেয়েও বিস্ময়কর ছিল তাঁর মন—যেখানে ছিল দার্শনিক চিন্তা, ছিল মানবতাবোধ।
আলেকজান্ডারের জীবন ছিল যেন এক বিপুল যাত্রা—যেখানে ছিল যুদ্ধের দামামা, কিন্তু তেমনি ছিল আত্মসন্ধান, বন্ধুত্বের মূল্য, এবং হারানোর ব্যথাও। তিনি শুধু একজন সেনাপতি ছিলেন না, ছিলেন একজন স্বপ্নবাজ মানুষ, যিনি বিশ্বাস করতেন, “পুরো মানবজাতি এক বৃহৎ পরিবারের মতো হতে পারে।”
প্রতিটি পদক্ষেপে ছিল অনিশ্চয়তা, প্রতিটি বিজয়ে লুকিয়ে ছিল ত্যাগের গল্প। হাজার হাজার কিলোমিটার অতিক্রম করার পথে তিনি যেমন শত্রু জয় করেছেন, তেমনি হৃদয় জয় করেছেন অজানা জাতির, সংস্কৃতির মানুষের।
এই প্রবন্ধে আমরা ফিরে তাকাবো সেই মানুষটির জীবনের দিকে, যার মৃত্যু ঘটেছিল মাত্র ৩২ বছর বয়সে, কিন্তু যাঁর স্বপ্ন ও অর্জন অমর হয়ে আছে ইতিহাসে। আমরা জানব তার শৈশবের গল্প, যুদ্ধের পটভূমি, ভারত অভিযানের রোমাঞ্চ, মৃত্যুর রহস্য, এবং তিনি আমাদের জন্য কী রেখে গেছেন। কারণ আলেকজান্ডার ছিলেন শুধুই একজন রাজা নন—তিনি ছিলেন এমন এক মানুষ, যিনি “মহান” শব্দটিকে অর্থপূর্ণ করে তুলেছেন।
Table of Contents
আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট কে ছিলেন?
আলেকজান্ডার জন্মগ্রহণ করেন খ্রিস্টপূর্ব ৩৫৬ সালে, গ্রীসের ম্যাসেডোনিয়া অঞ্চলের পেল্লা শহরে। তার পিতা ছিলেন রাজা ফিলিপ দ্বিতীয় এবং মাতা অলিম্পিয়াস। ছোটবেলা থেকেই তিনি সাহসী, প্রতিভাবান এবং কৌতূহলী ছিলেন। অল্প বয়সেই তার মধ্যে নেতৃত্বের গুণ ফুটে ওঠে।

তার জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো শিক্ষা। তিনি দার্শনিক এরিস্টটলের ছাত্র ছিলেন। এরিস্টটল তাকে শুধুমাত্র জ্ঞানই দেননি, বরং দৃষ্টিভঙ্গি দিয়েছিলেন—বিশ্বকে একটি ইউনিভার্সাল সাম্রাজ্য হিসেবে দেখার।
কৈশোরেই তিনি দেখেছিলেন তার পিতার রাজনৈতিক ও সামরিক সাফল্য। রাজা ফিলিপ গ্রীসের বিভিন্ন শহর-রাষ্ট্র দখল করে ম্যাসেডোনিয়াকে একটি শক্তিশালী রাষ্ট্রে পরিণত করেছিলেন। এই পটভূমিতেই আলেকজান্ডার গড়ে ওঠেন এবং পিতার মৃত্যুর পর মাত্র ২০ বছর বয়সে রাজা হন।
এই তরুণ রাজা খুব দ্রুতই প্রমাণ করেন যে তিনি শুধুমাত্র উত্তরাধিকার সূত্রে নয়, যোগ্যতা দিয়েই রাজত্ব করছেন। তার শৈশব থেকেই বোঝা যায়, তিনি ছিলেন অসাধারণ, অদম্য এবং ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত এক যোদ্ধা।
কীভাবে আলেকজান্ডার বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তুললেন?
আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের বিজয়যাত্রা শুরু হয়েছিল ম্যাসেডোনিয়ার সিংহাসনে বসার পর থেকেই। তিনি তার পিতার অসমাপ্ত স্বপ্ন—পারস্য সাম্রাজ্য জয় করার লক্ষ্য নিয়েই অভিযান শুরু করেন। তখনকার পারস্য ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী সাম্রাজ্য। কিন্তু আলেকজান্ডার থামেননি। একের পর এক যুদ্ধ জিতে তিনি পারস্যের রাজধানী পারসেপোলিস দখল করেন।

তার বিজয়ের পেছনে ছিল অসাধারণ কৌশল, অনুপ্রেরণাদায়ক নেতৃত্ব এবং দৃঢ় মানসিকতা। সৈন্যদের সঙ্গে মিশে যাওয়া, তাদের ভালোবাসা অর্জন, এবং নিজের জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করা—এই গুণগুলো তাকে সৈন্যদের কাছে একজন দেবতুল্য নেতা করে তোলে।
আলেকজান্ডার তার সাম্রাজ্য শুধু যুদ্ধ করেই গড়ে তোলেননি, বরং সাংস্কৃতিক বিনিময় ও সম্প্রীতির মধ্য দিয়েও বিস্তার করেছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, বিভিন্ন জাতি ও সংস্কৃতির মধ্যে ঐক্য সম্ভব। সে কারণে তিনি পরাজিত শাসকদের অনেককেই প্রশাসনে যুক্ত করেন এবং নিজেও পারস্য নারীদের বিয়ে করেন।
মাত্র ১১ বছরের মধ্যে তিনি গ্রীস থেকে শুরু করে মিশর, পারস্য, মধ্য এশিয়া এবং ভারত পর্যন্ত বিস্তৃত একটি সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিলেন। এই বিস্ময়কর সাফল্যই তাকে ‘দ্য গ্রেট’ উপাধি এনে দেয়। ইতিহাসে এমন বিস্তৃত সাম্রাজ্য এত অল্প সময়ে আর কেউ গড়ে তুলতে পারেননি।
ভারত অভিযান ও রাজা পোরাসের সঙ্গে যুদ্ধ
খ্রিস্টপূর্ব ৩২৬ সালে আলেকজান্ডার প্রবেশ করেন ভারতের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে। তার লক্ষ্য ছিল গঙ্গা অববাহিকা পর্যন্ত এগিয়ে যাওয়া। কিন্তু পথে পড়ে গেলেন এক সাহসী শাসকের মুখোমুখি—রাজা পোরাস। পাঞ্জাবের হাইডাসপিস নদীর তীরে হয় তাদের মহারণ।

এই যুদ্ধ ইতিহাসে পরিচিত ‘Battle of the Hydaspes’ নামে—একটি সংঘর্ষ যেখানে শুধু অস্ত্রের ঝংকার ছিল না, ছিল দুই মহান যোদ্ধার আত্মমর্যাদা ও সাহসের সংঘর্ষ। পোরাস ছিলেন এক সাহসী, চতুর ও সম্মানিত সেনানায়ক—যিনি শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত লড়াই করেছিলেন নিজের ভূমি, নিজের মানুষের জন্য।
যুদ্ধ ছিল রক্তক্ষয়ী, নিষ্ঠুর এবং কঠিন। দুই পক্ষের সৈন্যদের চিৎকার, ঘোড়ার হাহাকার আর বৃষ্টিভেজা মাটির গন্ধ আজও যেন বাতাসে ভাসে। শেষ পর্যন্ত আলেকজান্ডার বিজয়ী হন—তবে কেবল শক্তিতে নয়, মানবিকতায়ও।
কারণ এই যুদ্ধে জয় পাওয়ার পরও তিনি পোরাসকে শাস্তি দেননি। বরং তাঁর বীরত্বে এতটাই মুগ্ধ হয়ে যান যে, তাকে তার রাজ্য ফিরিয়ে দেন সম্মানের সাথে। এই ঘটনাই প্রমাণ করে, আলেকজান্ডারের চোখে শত্রুও যদি মহান হয়, তবে তাকে শ্রদ্ধা জানানো উচিত।
এই যুদ্ধের একটি বড় শিক্ষা ছিল—আলেকজান্ডার শুধু একজন যোদ্ধা ছিলেন না, তিনি একজন দার্শনিক নেতৃত্বও ছিলেন। তিনি বুঝতেন, সাহসী শত্রুকে হত্যা না করে বন্ধুত্ব করা অনেক বড় বিজয়। এই মনোভাবই তাকে অন্য জেনারেলদের চেয়ে আলাদা করেছিল।
ভারতীয় উপমহাদেশে এই যুদ্ধ আজও ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ হিসেবে বিবেচিত হয়। এটি আলেকজান্ডারের সামরিক প্রতিভা এবং মানবিক নেতৃত্বের দৃষ্টান্ত হয়ে আছে।
কেন আলেকজান্ডার ফিরে যান ভারত থেকে?
পোরাসের সঙ্গে যুদ্ধের পর আলেকজান্ডার এগিয়ে যেতে চেয়েছিলেন আরও গভীরে, গঙ্গার দিক বরাবর। কিন্তু তার সৈন্যরা তখন দীর্ঘ যাত্রায় ক্লান্ত, অবসন্ন এবং অজানা ভূমির ভয়ে আতঙ্কিত। তারা বিদ্রোহের ইঙ্গিত দিতে থাকে। আলেকজান্ডার তখন উপলব্ধি করেন, সেনাপতি হয়েও সব কিছু জোর করে এগিয়ে নেয়া যায় না।
তিনি সৈন্যদের ইচ্ছার প্রতি সম্মান দেখিয়ে ভারত থেকে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এটি ছিল তার জীবনের একটি কৌশলী এবং মানবিক সিদ্ধান্ত। ফিরতি পথে তিনি সিন্ধু ও বেলুচিস্তান হয়ে পারস্যে ফিরে যান।
এই সিদ্ধান্ত আলেকজান্ডারের নেতৃত্বের একটি দারুণ দৃষ্টান্ত। তিনি বোঝাতে চেয়েছেন, একজন সত্যিকারের নেতা প্রয়োজনে নিজের লক্ষ্য ছেড়ে সৈন্যদের মঙ্গলের কথা ভাবে। এই মানবিকতা তাকে শুধুমাত্র বিজয়ী নয়, এক মহান শাসক হিসেবেও প্রতিষ্ঠা করে।
তার ভারত অভিযান শেষ হয়েছিল যুদ্ধজয়ের মাধ্যমে, কিন্তু ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত ছিল আরও বড় এক মানবিক জয়।
আলেকজান্ডার কীভাবে মারা যান?
খ্রিস্টপূর্ব ৩২৩ সালে, মাত্র ৩২ বছর বয়সে আলেকজান্ডারের মৃত্যু ঘটে ব্যাবিলনে। এত অল্প বয়সে এমন এক মহান সাম্রাজ্য নির্মাতা কীভাবে মারা গেলেন—এ নিয়ে ইতিহাসবিদদের মধ্যে বিস্তর মতভেদ রয়েছে। কেউ বলেন জ্বর, কেউ বলেন ম্যালেরিয়া, আবার কেউ সন্দেহ করেন বিষক্রিয়ায় মৃত্যুর কথা।
মৃত্যুর আগে তিনি ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েন। কয়েকদিন ধরে তার শরীরে তীব্র জ্বর ছিল, শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল এবং ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়ছিলেন। তার মৃত্যুর খবর পুরো সাম্রাজ্যে শোকের ছায়া ফেলে। সৈন্যরা কান্নায় ভেঙে পড়েন, কারণ তাদের দেবতুল্য নেতা হঠাৎ করে হারিয়ে গেলেন।
মৃত্যুর সময় তিনি কোনো উত্তরাধিকারী ঘোষণা করেননি। কেউ কেউ বলেন, তিনি বলেছিলেন “সবচেয়ে যোগ্যজনের হাতে সাম্রাজ্য তুলে দিতে।” এই উক্তিটি পরবর্তীতে বড় ধরনের ক্ষমতার লড়াইয়ের সূত্রপাত করে।
তার মৃত্যু ছিল শুধু একজন ব্যক্তির মৃত্যু নয়, ছিল এক স্বপ্নের ভাঙন। আলেকজান্ডার তার জীবন দিয়ে ইতিহাস গড়েছিলেন, কিন্তু মৃত্যুর পর তার সাম্রাজ্য ধীরে ধীরে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। তবুও, তার নাম আজও অমর।
আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর কী ঘটেছিল?
আলেকজান্ডারের হঠাৎ মৃত্যু সমগ্র সাম্রাজ্যে এক বিশাল শূন্যতা তৈরি করে। যেহেতু তিনি কোনো স্পষ্ট উত্তরাধিকারী রেখে যাননি, তাই তার সেনাপতিরা এবং ঘনিষ্ঠরা ক্ষমতার জন্য লড়াই শুরু করেন। এই গৃহযুদ্ধকে ইতিহাসে “The Wars of the Diadochi” নামে ডাকা হয়।
তার সেনাপতিরা সাম্রাজ্যকে ভাগ করে নেয়: প্টোলোমি মিশর নেন, সেলেউকাস পারস্য ও মধ্য এশিয়া, লিসিম্যাকাস গ্রীসের কিছু অংশ এবং ক্যাস্যান্ডার ম্যাসেডোনিয়া। এই বিভাজনের ফলে এক সময় শক্তিশালী সাম্রাজ্য ছোট ছোট রাজ্যে পরিণত হয়।
এছাড়া, আলেকজান্ডারের আদর্শ ও সংস্কৃতির ছোঁয়া অনেক দেশে ছড়িয়ে পড়ে। তার তৈরি শহরগুলি যেমন—আলেকজান্দ্রিয়া, হয়ে ওঠে জ্ঞান, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতির কেন্দ্র। তবে রাজনৈতিকভাবে তার মৃত্যুর পর সাম্রাজ্য আর ঐক্যবদ্ধ থাকে না।
এই অধ্যায় আমাদের শেখায়, একটি শক্তিশালী নেতৃত্ব ছাড়া বড় সাম্রাজ্যও অস্থায়ী। আলেকজান্ডার ছিলেন সেই কাঁচা সুতো, যিনি বিভিন্ন জাতিকে একসূত্রে গেঁথেছিলেন। তার অনুপস্থিতিতে সেই সুতো খুলে যায়।
আলেকজান্ডারের দেহ কোথায়?
আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর তার দেহ কোথায় রাখা হয়েছে—এ নিয়ে বহু বিতর্ক ও রহস্য রয়েছে। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হয়েছিল, তার দেহ ব্যাবিলনে রাখা হবে। কিন্তু প্টোলোমি তার দেহ মিশরে নিয়ে যান এবং আলেকজান্দ্রিয়া শহরে সমাধিস্থ করেন।
প্রাচীন ইতিহাস অনুযায়ী, আলেকজান্দ্রিয়ায় তার জন্য এক বিশাল সমাধি তৈরি করা হয়েছিল, যা ছিল মার্বেল, স্বর্ণ ও রত্নখচিত। প্রাচীন রোমান সম্রাটরাও এই সমাধি দর্শন করতে যেতেন। কিন্তু কয়েক শতাব্দী পর এই সমাধি রহস্যজনকভাবে হারিয়ে যায়।
অনেক গবেষক মনে করেন, আজও মিশরের কোথাও তার সমাধি লুকিয়ে আছে। কেউ কেউ দাবি করেন যে তার দেহকে ধর্মীয় কারণে গোপন রাখা হয়েছে। এই রহস্য আজও ইতিহাসবিদদের কাছে এক চ্যালেঞ্জ হয়ে আছে।
তার দেহের অবস্থান না জানা গেলেও, তার আদর্শ, তার কীর্তি ও তার নাম আজও বেঁচে আছে কোটি কোটি মানুষের মনে। হয়তো এটাই এক মহান নেতার আসল অমরত্ব।
আলেকজান্ডারের প্রতিষ্ঠিত শহর ও ঐতিহ্য
আলেকজান্ডার কেবল যুদ্ধ করেই সাম্রাজ্য গড়ে তোলেননি, বরং শহর ও সভ্যতা গড়ে তোলার কাজও করেছেন। ইতিহাস অনুযায়ী, তিনি ২০টিরও বেশি শহর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যেগুলোর অনেকগুলোই তার নামে নামকরণ করা হয়—যেমন “আলেকজান্দ্রিয়া।” সবচেয়ে বিখ্যাত শহরটি মিশরের আলেকজান্দ্রিয়া।
এই শহরগুলো শুধু সামরিক ঘাঁটি ছিল না, বরং শিক্ষার, বাণিজ্যের এবং সাংস্কৃতিক মিলনের কেন্দ্র ছিল। মিশরের আলেকজান্দ্রিয়া শহরে তৈরি হয়েছিল পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ লাইব্রেরি—আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরি। এই শহরগুলোতে গ্রীক, পারস্য, মিশরীয় এবং ভারতীয় সংস্কৃতির মিশ্রণে এক নতুন ধরনের সভ্যতা জন্ম নেয়, যাকে বলা হয় “হেলেনিস্টিক সভ্যতা।”
আলেকজান্ডারের শহরগুলো যুগের পর যুগ ধরে জ্ঞানের আলো ছড়িয়েছে। আজও অনেক শহরে তার নাম ও প্রভাব দেখা যায়। তার এই শহর-প্রতিষ্ঠান প্রমাণ করে, তিনি যুদ্ধের বাইরেও সভ্যতা গঠনে বিশ্বাস করতেন।
এই অধ্যায় থেকে বোঝা যায়, আলেকজান্ডার কেবল একজন বিজয়ী ছিলেন না, ছিলেন এক নির্মাতা। তাঁর শহরগুলোই তার দীর্ঘমেয়াদী চিন্তাধারার প্রতিফলন। আজও সেগুলো সাক্ষ্য বহন করে এক অসামান্য নেতার।
ইতিহাস তাকে ‘মহান’ বলেছে কেন?
“দ্য গ্রেট”—এই উপাধি সবাই পায় না। আলেকজান্ডার এই উপাধি পেয়েছেন তার সাহস, দূরদর্শিতা, মানবিকতা ও বিশ্বজনীন দৃষ্টিভঙ্গির জন্য। তিনি ছিলেন একাধারে যোদ্ধা, দার্শনিক এবং সংস্কৃতির বাহক।
তার নেতৃত্বের ধরন ছিল অনন্য। সৈন্যদের মধ্যে মিশে যাওয়া, শত্রুকে শ্রদ্ধা করা, পরাজিতদের পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করা—এসব গুণ একজন সাধারণ রাজার মধ্যে দেখা যায় না। তিনি বিশ্বাস করতেন, শক্তি মানেই দখল নয়; শক্তি মানে ঐক্য সৃষ্টি করা।
তার যাত্রা ছিল একটি দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন—বিশ্বকে এক পরিবার হিসেবে দেখার। সেই চিন্তাধারাই তাকে অনেকের চেয়ে বড় করে তুলেছে। মৃত্যুর শত শত বছর পরও ইতিহাসে তার নাম এখনও গর্বের সাথে উচ্চারিত হয়।
আলেকজান্ডার ছিলেন না নিছক একজন দখলদার; তিনি ছিলেন একজন স্বপ্নদ্রষ্টা। ইতিহাস তাকে তাই শুধু ‘জয়ী’ নয়, ‘মহান’ হিসেবেই স্মরণ করে।
আলেকজান্ডারের জীবন শুধুই যুদ্ধের নয়—তা ছিল এক দার্শনিক অভিযান
অলৌকিক বীরত্ব, অপ্রতিরোধ্য সামরিক শক্তি এবং অজেয় বিজয়ের প্রতীক হিসেবে আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটকে আমরা অনেকেই চিনি। কিন্তু তার জীবন কেবল যুদ্ধজয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। তার পথচলা ছিল এক গভীর দার্শনিক অভিযাত্রা—জীবন, সংস্কৃতি এবং মানবতার গভীর অনুসন্ধান।
শিশুকাল থেকেই আলেকজান্ডারকে প্লেটোর শিষ্য অ্যারিস্টটলের তত্ত্বে গড়ে তোলা হয়েছিল। জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রতি তার ভালোবাসা যুদ্ধের মাঠেও তার সঙ্গে ছিল। সে শুধু রাষ্ট্র দখল করেনি, বরং ভাষা, দর্শন, শিল্প ও বৈজ্ঞানিক চেতনার বিস্তার ঘটিয়েছে। ভারত, পারস্য, মিশর—যেখানেই তিনি গেছেন, সেখানে কেবল অস্ত্রের নয়, জ্ঞানের আলো ছড়িয়েছেন।
তার অভিযান ছিল এক ধরণের “মানব সভ্যতার সংলাপ”। তিনি প্রতিটি বিজিত জাতির সংস্কৃতি জানার চেষ্টা করেছেন, অনেক সময় সে সংস্কৃতিকে নিজের ভিতরে গ্রহণও করেছেন। আলেকজান্ডার গ্রিক ও প্রাচ্য সংস্কৃতির সংমিশ্রণ ঘটিয়ে এক নতুন সভ্যতার জন্ম দিয়েছিলেন, যা হেলেনিস্টিক সভ্যতা নামে পরিচিত।
আলেকজান্ডার ছিলেন কৌতূহলী, সাহসী, কিন্তু একইসঙ্গে আত্মবিশ্লেষণশীল। তার ডায়েরিতে পাওয়া যায় এমন অনেক প্রশ্ন—”মানুষ কেন যুদ্ধ করে?”, “জীবনের আসল অর্থ কী?”, এমনকি “আমি কি সত্যিই মহান?” এই প্রশ্নগুলো শুধু এক যোদ্ধার নয়, একজন দার্শনিক চিন্তাবিদের মন থেকে উঠে এসেছে।
তার জীবন আজও প্রেরণা ও গবেষণার উৎস
আলেকজান্ডার আজও ইতিহাসবিদ, মনোবিজ্ঞানী, দার্শনিক এমনকি রাজনীতিকদের জন্য গবেষণার এক অতল ভাণ্ডার। কারণ, তিনি একমাত্র সেই মানুষদের মধ্যে অন্যতম, যিনি নিজের সময়ের সব সীমা ছাড়িয়ে ভবিষ্যৎকেও প্রভাবিত করে গেছেন।
তার জীবনের প্রতিটি অধ্যায়—যুদ্ধ, প্রেম, বিশ্বাসঘাতকতা, বন্ধুত্ব ও আত্মসমর্পণের গল্পে একেকটা মানুষের জীবনের ছায়া পাওয়া যায়। এ যেন শুধুই ইতিহাস নয়, এক গভীর মানব-গল্প। তার আকাঙ্ক্ষা ছিল অমরত্বের—তাই তিনি শুধু মাটি দখল করেননি, মানুষের কল্পনাকেও দখল করেছেন।
আজকের যুগে, যেখানে নেতৃত্ব মানে কেবল ক্ষমতা নয়, মূল্যবোধ ও আদর্শের ওপর দাঁড়ানো উচিত—সেখানে আলেকজান্ডার হয়ে উঠতে পারেন এক যুগান্তকারী অনুপ্রেরণা। তার জীবনের শিক্ষা আমাদের মনে করিয়ে দেয়, সত্যিকারের নেতা সেই, যে নিজের জাতিকেও এগিয়ে নিয়ে যায় এবং অন্য জাতিকেও সম্মান করে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে আলেকজান্ডার নিয়ে গবেষণাপত্র লেখা হয়, তাঁর যুদ্ধ কৌশল শেখানো হয় মিলিটারি একাডেমিতে, আর তাঁর কূটনৈতিক বুদ্ধি অনুপ্রেরণা দেয় আধুনিক রাজনীতিকে। তার মৃত্যু আজও রহস্যে মোড়ানো, কিন্তু তার জীবনের আবেদন আজও তাজা, আজও প্রাণবন্ত।
“মহান” হওয়া মানে কী, তার প্রকৃত ব্যাখ্যা হয়তো তিনিই দিয়ে গেছেন
আজ যখন আমরা কাউকে “মহান” বলি, তখন মূলত কী বোঝাতে চাই? শুধু জয়? না কি মানুষের হৃদয় জয় করাও এর অংশ? আলেকজান্ডারের গল্প আমাদের শেখায়—মহানতা মানে কেবল শত্রু পরাস্ত করা নয়, নিজেকে পরাজিত করাও।
তিনি ছিলেন এক বিস্ময়কর মানুষ—যিনি শৈশবে ছিলেন স্বপ্নদ্রষ্টা, যৌবনে বিজয়ী সম্রাট, আর বার্ধক্যে একজন আত্মবিশ্লেষণশীল দর্শনপ্রিয় মানুষ। আলেকজান্ডারের মহানতা ছিল তার দৃষ্টিভঙ্গিতে—তিনি সীমার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে জানতেন না। সাহসিকতা, কৌশল এবং সহানুভূতির এক বিরল মিশ্রণ ছিল তার চরিত্রে।
সে যেভাবে নিজেকে দেখেছেন, তা কেবল একজন সমরনায়কের চোখে নয়—বরং একজন ভাবুকের চোখে, একজন মানুষের চোখে। তার মহত্ত্ব আসলে ছিল তার দৃষ্টিভঙ্গিতে—সে অন্য সংস্কৃতি ও ভাষাকে গ্রহণ করেছে, অন্য জাতিকে শত্রু নয় বরং বন্ধু হিসেবে দেখেছে। এই মানবিকতা তাকে মহান করেছে।
আলেকজান্ডার শিখিয়েছেন—যুদ্ধ কখনও শেষ নয়, তবে আত্মজয়ই চূড়ান্ত বিজয়। হয়তো আজ আমরা আধুনিক প্রযুক্তিতে অনেক এগিয়ে, কিন্তু যদি আলেকজান্ডারের মতো আত্মবিশ্বাস, জ্ঞানপিপাসা ও মানবিকতা না থাকে—তাহলে সত্যিকারের “মহান” হওয়া সম্ভব নয়।
এভাবেই তিনি আজও প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন—তুমি কি সত্যিই ‘মহান’ হতে চাও? যদি চাও, তাহলে কেবল যুদ্ধ নয়, জ্ঞান, সহানুভূতি ও সত্যের পথেই তোমার যাত্রা শুরু করো।