ভূমিকম্পের নীচে লুকিয়ে থাকা রহস্য: চট্টগ্রামে ক্রমাগত ভূমিকম্প কেন?
গত কয়েক মাসে চট্টগ্রামবাসী এক অস্বস্তিকর অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। রাত হোক বা দিন—আকস্মিক কাঁপুনি, ঘর-বাড়ির দেয়ালে ফাটল, এবং মানুষের চোখে-মুখে আতঙ্ক। মে মাসের শুরুতেই কয়েক সেকেন্ডের ভূকম্পন চট্টগ্রাম শহরের বিভিন্ন এলাকায় টের পাওয়া গেছে। তার আগেও এপ্রিল এবং মার্চ মাসে কয়েকটি ছোট ও মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। এমন ঘনঘন কম্পনের পেছনে কী কারণ থাকতে পারে?
পৃথিবীর ভূগর্ভে কি নতুন কিছু ঘটছে? অনেকে প্রশ্ন তুলছেন—চট্টগ্রামের নিচে কি তবে লুকিয়ে আছে একটি সুপ্ত আগ্নেয়গিরি? নাকি এটি স্রেফ একটি স্বাভাবিক টেকটনিক প্লেটের নড়াচড়া?
এই প্রশ্নগুলোই এখন বিজ্ঞানী, গবেষক এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। চট্টগ্রাম শহর, তার পার্বত্য অঞ্চল এবং বঙ্গোপসাগরের নীচে কী আছে, যা এমন অস্বাভাবিক ভূকম্পন সৃষ্টি করছে? চলুন, খুঁজে দেখা যাক এই কাঁপন-পেছনের গোপন রহস্য।

Table of Contents
চট্টগ্রামে ভূমিকম্প – ইতিহাস ও বর্তমান
চট্টগ্রাম অঞ্চল ভূতাত্ত্বিকভাবে অত্যন্ত সংবেদনশীল। বাংলাদেশ যেহেতু তিনটি টেকটনিক প্লেটের সংযোগস্থলে অবস্থিত, তাই এই অঞ্চলে মাঝেমধ্যেই ভূমিকম্প অনুভূত হয়। বিশেষ করে চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, কক্সবাজার এবং তৎসংলগ্ন এলাকা এসব ভূকম্পনের প্রধান কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে।
বিগত দশকে ঘটে যাওয়া উল্লেখযোগ্য ভূমিকম্প
গত এক দশকে চট্টগ্রামে বেশ কিছু মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছে, যার কিছু উল্লেখযোগ্য ঘটনা নিচে তুলে ধরা হলো:
- ২০১৭ সালের ১৩ জানুয়ারি: চট্টগ্রামে ৫.১ মাত্রার ভূমিকম্প অনুভূত হয়, যার উৎস ছিল মায়ানমার সীমান্তের কাছাকাছি।
- ২০২১ সালের ২৬ নভেম্বর: গভীর রাতে ৫.৮ মাত্রার একটি ভূমিকম্প চট্টগ্রামসহ দেশের দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলে কাঁপন তোলে।
- ২০২3 সালের জুলাই মাস: টানা কয়েক দিনের ব্যবধানে চট্টগ্রামে তিনটি হালকা থেকে মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্প রেকর্ড করা হয়।
- ২০২৫ সালের এপ্রিল–মে: চলতি বছরেই অন্তত চারবার ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে চট্টগ্রাম শহরে ও পার্শ্ববর্তী জেলাগুলিতে। একেকটির মাত্রা ছিল ৪.২ থেকে ৫.৫ এর মধ্যে।
ভূমিকম্পের মাত্রা ও বিস্তৃতি
এই ভূমিকম্পগুলোর বেশিরভাগই রিখটার স্কেলে ৪ থেকে ৬ মাত্রার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও, কিছু ভূমিকম্প গভীর উৎসস্থলের কারণে দূর-দূরান্তেও অনুভূত হয়েছে। বেশ কয়েকটি ভূমিকম্প এমনও হয়েছে, যেগুলো কেবল চট্টগ্রাম শহরে নয়, বরং ফেনী, কক্সবাজার, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানেও কম্পন সৃষ্টি করেছে।
ভূকম্পনের গভীরতা এবং কেন্দ্রস্থলের ভিন্নতার কারণে কখনো কাঁপুনি কিছু সেকেন্ড স্থায়ী হয়, আবার কখনো তা আতঙ্কিত জনসাধারণকে বাড়ির বাইরে বের করে আনতে বাধ্য করে।
সাধারণ মানুষের প্রতিক্রিয়া ও আতঙ্ক
চট্টগ্রামের বাসিন্দারা বর্তমানে এক অস্থির ও আতঙ্কগ্রস্ত অবস্থায় আছেন। হঠাৎ কেঁপে ওঠা দেয়াল, দুলে ওঠা ফ্যান কিংবা আলনা দেখে অনেকেই ঘর ছেড়ে রাস্তায় নেমে আসছেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ছে নানা গুজব—কেউ বলছে, ভূগর্ভে গ্যাসের চাপ বাড়ছে, কেউ আবার সুপ্ত আগ্নেয়গিরির আশঙ্কা করছেন।
স্কুল-কলেজ, অফিস কিংবা হাসপাতাল—সব জায়গায় যেন এক অদৃশ্য ভয়ের ছায়া। বিশেষ করে যাদের বাড়ি পাহাড়ঘেঁষা এলাকায়, তারা বেশি আতঙ্কিত।
স্থানীয় প্রশাসন এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর থেকে এখন পর্যন্ত কোনো বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতির খবর না এলেও, ভবিষ্যতে বড় ভূমিকম্পের আশঙ্কা নাকচ করে দিচ্ছেন না সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা।
বাংলাদেশের বিজ্ঞানীদের ৮টি অবহেলিত আবিষ্কার
ভূতাত্ত্বিক অবস্থান ও সক্রিয় প্লেট টেকটনিকস
চট্টগ্রামের ভূমিকম্প প্রবণতার পেছনে অন্যতম বড় কারণ হলো এর ভূতাত্ত্বিক অবস্থান। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল তথা চট্টগ্রাম অঞ্চলের নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে দুটি সক্রিয় টেকটনিক প্লেট—ভারতীয় প্লেট এবং বার্মা প্লেট—যার সংযোগস্থলে অবস্থিত চট্টগ্রাম হয়ে উঠেছে একটি ভূমিকম্প-সংবেদনশীল অঞ্চল।
চট্টগ্রামের অবস্থান ভারতীয় ও বার্মা প্লেটের সংযোগস্থলে
পৃথিবীর ভূত্বকের বড় বড় খণ্ডগুলোর নাম টেকটনিক প্লেট, যেগুলো একে অপরের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত থাকে বা একে অপরের নিচে চলে যায়। বাংলাদেশ যেহেতু ভারতীয় প্লেটের পূর্ব প্রান্তে এবং বার্মা মাইক্রোপ্লেটের পশ্চিম প্রান্তে অবস্থান করছে, তাই চট্টগ্রাম অঞ্চলের ওপর তৈরি হচ্ছে প্রবল ভূতাত্ত্বিক চাপ।
এই দুই প্লেটের মাঝে রয়েছে একটি জটিল সাবডাকশন জোন, যার মাধ্যমে ভারতীয় প্লেট ধীরে ধীরে বার্মা প্লেটের নিচে চলে যাচ্ছে। এই ধরণের প্লেট মুভমেন্ট সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ভূকম্পীয় শক্তি সঞ্চয় করে, যা হঠাৎ করে মুক্তি পেলে ভূমিকম্পের সৃষ্টি হয়।
টেকটনিক প্লেট সংঘর্ষের ফলে ভূমিকম্প
চট্টগ্রাম এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে গত কয়েক দশক ধরে যে ছোট থেকে মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্প হচ্ছে, তার বেশিরভাগই এই প্লেট সংঘর্ষজনিত। বিজ্ঞানীরা বলছেন, প্লেটের নড়াচড়া প্রতিনিয়ত হচ্ছে, কিন্তু ভূমিকম্প হয় তখনই যখন চাপ একটি নির্দিষ্ট মাত্রা ছাড়িয়ে যায়।
বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, এই এলাকায় বড় ধরনের একটি ভূমিকম্প—যাকে মেগাথ্রাস্ট ইভেন্ট বলা হয়—ঘটতে পারে, যদি সঞ্চিত শক্তি হঠাৎ করে মুক্তি পায়। এতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হতে পারে চট্টগ্রাম শহর ও পার্বত্য অঞ্চলজুড়ে।

ভূতত্ত্ববিদদের মতামত
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূবিজ্ঞান বিভাগের একাধিক অধ্যাপক, বাংলাদেশ ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদপ্তর (GSB), এবং আন্তর্জাতিক গবেষকরা একমত যে চট্টগ্রাম একটি ভূমিকম্পপ্রবণ হটস্পট।
বিশিষ্ট ভূতত্ত্ববিদ ড. হুমায়ুন কবির এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন:
“চট্টগ্রামের নিচে সাবডাকশন জোন রয়েছে, যা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যতম জটিল ভূতাত্ত্বিক কাঠামো। দীর্ঘ সময় ধরে চাপ জমে গেলে হঠাৎ বড় ধরনের ভূমিকম্প হওয়ার আশঙ্কা অস্বীকার করা যায় না।”
আরও কিছু গবেষক বলছেন, চট্টগ্রামের ভূগর্ভে এমন কিছু অস্পষ্ট গঠন দেখা যাচ্ছে যা সুপ্ত আগ্নেয়গিরির ইঙ্গিতও দিতে পারে। তবে এ বিষয়ে নিশ্চিতভাবে কিছু বলার জন্য আরও গভীর ও দীর্ঘমেয়াদি গবেষণা প্রয়োজন।
বিজ্ঞানী ও গবেষকদের মতামত
চট্টগ্রামে বারবার ভূমিকম্পের ঘটনায় অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন—এটা কি শুধু টেকটনিক প্লেটের সংঘর্ষ, নাকি এর পেছনে লুকিয়ে আছে আরও বড় কোনো ভূতাত্ত্বিক রহস্য? বিশেষ করে “সুপ্ত আগ্নেয়গিরি” ধারণাটি ঘুরে ফিরে আসছে জনমনে ও গবেষক মহলে।
বাংলাদেশের ভূতত্ত্ববিদদের গবেষণা ও বক্তব্য
বাংলাদেশের একাধিক ভূতত্ত্ববিদ, বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূবিজ্ঞান বিভাগ এবং বাংলাদেশ ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদপ্তরের (GSB) গবেষকরা চট্টগ্রামের ভূগর্ভস্থ গঠনের উপর বিভিন্ন সময়ে গবেষণা চালিয়েছেন। তাঁদের মতে, চট্টগ্রাম অঞ্চলের ভূতাত্ত্বিক প্রক্রিয়া অত্যন্ত জটিল এবং এতে বহু রকম সম্ভাবনা রয়েছে, যার মধ্যে সুপ্ত আগ্নেয়গিরির তত্ত্ব এখনো পুরোপুরি নাকচ করা যাচ্ছে না।
ড. মিজানুর রহমান, ভূকম্পন বিশারদ, এক প্রতিবেদনে বলেছেন:
“চট্টগ্রামের ভূগর্ভে তাপমাত্রার কিছু অস্বাভাবিকতা এবং মাটির নিচের খনিজ গঠনে কিছু অসঙ্গতি লক্ষ্য করা গেছে। যদিও তা সরাসরি আগ্নেয়গিরির প্রমাণ নয়, কিন্তু বিষয়টি নিয়ে নজরদারি ও গভীর গবেষণা প্রয়োজন।”
কোনো আগ্নেয়গিরি সক্রিয় থাকলে তার চিহ্ন কী?
সাধারণত, একটি সক্রিয় বা সুপ্ত আগ্নেয়গিরির উপস্থিতি বুঝতে কিছু নির্দিষ্ট বৈজ্ঞানিক লক্ষণ দেখা যায়:
- ভূগর্ভে তাপমাত্রা বৃদ্ধি (হট স্পট অঞ্চল)
- মাটির নিচ থেকে গ্যাস নিঃসরণ (যেমন সালফার বা কার্বন ডাই-অক্সাইড)
- ভূ–গঠনে অস্বাভাবিক পরিবর্তন, যেমন পাহাড়ের আকৃতি পরিবর্তন বা উঁচু হওয়া
- বারবার ভূমিকম্প (বিশেষ করে অগভীর কম্পন)
- গ্রাউন্ড ডিফর্মেশন (মাটির ফুলে ওঠা বা বসে যাওয়া)
চট্টগ্রামে এখন পর্যন্ত এসব লক্ষণের কয়েকটি মিল পাওয়া গেলেও, সেগুলো সুপ্ত আগ্নেয়গিরির উপস্থিতির পক্ষে নিশ্চিত প্রমাণ নয় বলে গবেষকরা মত দিয়েছেন। তবে বিষয়টি একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না বলেই বিজ্ঞানীরা মনে করেন।
আন্তর্জাতিক গবেষণার প্রতিবেদন
২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের জিওলজিক্যাল সার্ভে (USGS) এবং জার্মান রিসার্চ সেন্টার ফর জিওসায়েন্স (GFZ) এর এক যৌথ গবেষণায় বলা হয়, চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের নিচে একটি “Deep Megathrust Zone” রয়েছে, যেখানে প্রচুর টেকটনিক চাপ জমা হচ্ছে।
তারা আশঙ্কা করেন, এ অঞ্চলে ভবিষ্যতে একটি বড় মাত্রার ভূমিকম্প বা ভূপৃষ্ঠে চাপ সৃষ্টিকারী কার্যকলাপ হতে পারে, যার মধ্যে আগ্নেয়গিরির সম্ভাবনা “fully negligible” নয়।
এছাড়াও, ২০২2 সালে NASA-এর ভূ–উপগ্রহের মাধ্যমে পর্যবেক্ষণ করা একটি প্রতিবেদনে চট্টগ্রাম অঞ্চলে কিছু অস্বাভাবিক তাপমাত্রাগত প্যাটার্ন ধরা পড়ে, যা নিয়ে GSB বর্তমানে গবেষণা চালাচ্ছে।
স্থানীয় জনমত ও মিডিয়া প্রভাব
চট্টগ্রামে একের পর এক ভূমিকম্পের ফলে সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। ভূমিকম্পের মাত্রা মাঝারি হলেও, তার ঘনঘনতা এবং অপ্রস্তুত নগর অবকাঠামো মানুষকে নিরাপত্তাহীনতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
চট্টগ্রামের সাধারণ মানুষের অভিজ্ঞতা ও ভয়
নগরের বাসিন্দাদের অনেকে বলছেন, ভূমিকম্পের সময় তারা বাড়ির দেয়াল ও আসবাবপত্র দুলতে দেখেছেন। কেউ কেউ জানিয়েছেন, ফাটল ধরেছে পুরনো ভবনে, বিশেষ করে পাহাড়ঘেঁষা এলাকায়।
একজন বাসিন্দা বলেন:
“মাঝরাতে ঘুম ভেঙে দেখি, দরজাটা দুলছে। বাচ্চারা ভয় পেয়ে কান্না শুরু করে। আমরা সবাই দৌড়ে নিচে নেমে আসি। এরপর থেকে ঘুমাতে ভয় লাগে।”
বিশেষ করে যেসব পরিবার পুরনো ও বহু তলা ভবনে থাকেন, তাদের মাঝে আতঙ্ক আরও বেশি। স্থানীয় দোকানি, পরিবহন চালক কিংবা স্কুলশিক্ষকরাও ভূমিকম্প নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছেন—“এই বুঝি বড় কিছু হয়ে গেল।”
সোশ্যাল মিডিয়া ও গুজব
ভয় আর অনিশ্চয়তার সুযোগ নিয়েই সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়াচ্ছে নানা রকম গুজব। কেউ বলছে, “আগামী সপ্তাহেই বড় ভূমিকম্প হবে,” কেউ আবার “সুপ্ত আগ্নেয়গিরি জেগে উঠেছে” বলেও প্রচার করছে।
TikTok, Facebook ও YouTube-এ কিছু ভূমিকম্প-সংক্রান্ত ভিডিওতে বাড়িয়ে বলা, আতঙ্ক সৃষ্টি করা তথ্য ব্যবহার করা হচ্ছে, যা সাধারণ মানুষকে আরও বিভ্রান্ত করছে।
এ ধরনের গুজবের কারণে অনেকেই ভুয়া প্রস্তুতি নিচ্ছেন, যেমন পানি-সংগ্রহ, বাড়ি ছাড়ার পরিকল্পনা, এমনকি শহর ছাড়ার কথাও ভাবছেন কেউ কেউ। অথচ এসব তথ্যের কোনও বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই।
মিডিয়ার ভূমিকা: আতঙ্ক না সচেতনতা?
মূলধারার সংবাদমাধ্যম—যেমন টেলিভিশন চ্যানেল, অনলাইন নিউজ পোর্টাল—এই ইস্যুতে কখনও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করেছে, আবার কখনও অতিরঞ্জিত শিরোনামে আতঙ্ক বাড়িয়েছে।
কিছু পত্রিকা শিরোনাম দিয়েছে:
- “চট্টগ্রাম কাঁপছে, ভয়াবহ কিছু আসছে?”
- “ভূগর্ভে আগ্নেয়গিরির সম্ভাবনা!”
এ ধরনের শিরোনাম জনসচেতনতায় সাহায্য না করে বরং ভয় আরও বাড়িয়েছে।
তবে ইতিবাচক দিক হলো—কয়েকটি গণমাধ্যম ভূকম্পন-সংক্রান্ত সতর্কতা, করণীয়, এবং বিজ্ঞানীদের বক্তব্য তুলে ধরেছে, যা সচেতনতা বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়েছে।
ভবিষ্যৎ কী বলে?
চট্টগ্রামে একের পর এক ভূমিকম্প সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে বিশেষজ্ঞ মহল পর্যন্ত সবাইকে ভাবিয়ে তুলেছে। এখন প্রশ্ন উঠছে—এখন কী হবে? ভবিষ্যতে চট্টগ্রামবাসীর জন্য কতটা বিপদ অপেক্ষা করছে?
বিজ্ঞান কী পরামর্শ দিচ্ছে?
ভূবিজ্ঞানীরা বলছেন, প্লেট টেকটনিক সংঘর্ষজনিত কারণে চট্টগ্রাম একটি ভূমিকম্প ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল এবং এ ঝুঁকি আগামী দিনগুলোতে আরও বাড়তে পারে।
বিশেষজ্ঞদের মতে:
- একাধিক ছোট ভূমিকম্প অনেক সময় বড় ভূমিকম্পের পূর্বাভাস হতে পারে।
- তবে সব সময় তা নিশ্চিত নয়, তাই অযথা আতঙ্ক না ছড়িয়ে, বৈজ্ঞানিক নজরদারি ও নিয়মিত পর্যবেক্ষণ চালিয়ে যেতে হবে।
- ভূমিকম্পের সময় করণীয় বিষয়ে সাধারণ মানুষকে সচেতন করা সবচেয়ে জরুরি।
ড. সালেহ উদ্দিন, ভূতত্ত্ব বিশেষজ্ঞ, বলেছেন:
“বড় ভূমিকম্প কখন ঘটবে, তা বলা কঠিন। কিন্তু ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা চিহ্নিত করে সেখানে সতর্ক ব্যবস্থা না নিলে ক্ষয়ক্ষতি অনেক বেশি হতে পারে।”
সতর্কতা ও প্রস্তুতির গুরুত্ব
যেহেতু ভূমিকম্প আগে থেকে নির্দিষ্ট করে জানা যায় না, তাই প্রস্তুতিই সবচেয়ে কার্যকর প্রতিরক্ষা। বিশেষ করে চট্টগ্রমের মতো ঘনবসতিপূর্ণ ও পুরনো ভবনসমৃদ্ধ শহরে:
- ভূমিকম্প সহনশীল ভবন নির্মাণ
- স্কুল, অফিস, ও আবাসিক এলাকায় নিয়মিত মকড্রিল (ভূমিকম্প মহড়া)
- মানুষকে প্রশিক্ষণ দিয়ে ভূমিকম্পের সময় নিজেকে রক্ষা করার কৌশল শেখানো
- জরুরি উদ্ধার ও চিকিৎসা ব্যবস্থার পূর্বপ্রস্তুতি রাখা
একটি মাত্র প্রস্তুত জনগোষ্ঠীই ভয়াবহ বিপর্যয়কে অনেকটাই সহনীয় করে তুলতে পারে।
ভূমিকম্প প্রতিরোধে সরকারের পরিকল্পনা
সরকার ইতোমধ্যে কিছু গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ নিয়েছে:
- ভূমিকম্প সনদ ছাড়াই ভবন নির্মাণে নিষেধাজ্ঞা
- রাজউক ও সিটি কর্পোরেশন কর্তৃক ভবন অডিট ও ঝুঁকিপূর্ণ ভবন চিহ্নিতকরণ
- জিওলজিকাল জরিপ ও মাটির গতিবিধি বিশ্লেষণ প্রকল্প চালু
- বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস, সিভিল ডিফেন্স, এবং সেনাবাহিনীর সমন্বয়ে ভূমিকম্প জরুরি প্রতিক্রিয়া ইউনিট গঠন
তবে বাস্তবতা হলো—অনেক পরিকল্পনা কাগজে কলমে থাকলেও বাস্তবায়নে গতি কম। স্থানীয় সরকার, নাগরিক সংগঠন ও সাধারণ মানুষের সমন্বয় ছাড়া এসব কার্যকর হবে না।
চট্টগ্রাম ভূমিকম্পপ্রবণ—এটা এখন শুধু জনশ্রুতি নয়, বরং বৈজ্ঞানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত বাস্তবতা।
তবে গুজব বা আতঙ্ক নয়, আমাদের প্রয়োজন সচেতনতা, বিজ্ঞানভিত্তিক পরিকল্পনা এবং কার্যকর প্রস্তুতি।
একটি সুসংগঠিত, সতর্ক চট্টগ্রামই পারে ভবিষ্যতের বিপর্যয়কে ঠেকাতে।