পোপ ফ্রান্সিসের মৃত্যুর পর এখন নতুন পোপ নির্বাচন করা হবে যেভাবে

নতুন পোপ নির্বাচন করা হবে যেভাবে

বেশ কিছু মাস অসুস্থ ছিলেন ক্যাথলিক খ্রিষ্টানদের প্রধান ধর্মীয় নেতা পোপ ফ্রান্সিস। এখন, মৃত্যুর পর নির্দিষ্ট নিয়ম-নীতি অনুসরণ করে সম্পন্ন হবে তাঁর শেষকৃত্য। নতুন পোপ নির্বাচিত হবেন ক্যাথলিক চার্চের শীর্ষ ধর্মযাজকদের ভোটে। এই দুটি প্রক্রিয়াই বেশ জটিল ও সময়সাপেক্ষ।

৮৮ বছর বয়সে প্রয়াত হওয়া ফ্রান্সিস ছিলেন দক্ষিণ আমেরিকা থেকে আগত প্রথম পোপ। এর আগে, ৭৪১ খ্রিস্টাব্দে সিরিয়ায় জন্ম নেওয়া তৃতীয় গ্রেগরির মৃত্যুর পর থেকে আর কোনো নন-ইউরোপীয় বিশপ পোপ হননি।

পোপ হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর ফ্রান্সিস অনেক ক্ষেত্রেই নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন, কিন্তু কখনোই চার্চ সংস্কারের কার্যক্রম থামিয়ে দেননি। তা সত্ত্বেও ঐতিহ্যকে আঁকড়ে ধরা রক্ষণশীলদের মাঝেও তাঁর জনপ্রিয়তা ছিল সমানভাবে। তাঁর মৃত্যু ক্যাথলিক খ্রিষ্টান সমাজে গভীর শোকের ছায়া ফেলেছে।

মৃত্যুর পূর্ববর্তী প্রায় ১২ বছর ধরে তিনি রোমান ক্যাথলিক চার্চের আধ্যাত্মিক নেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এখন, তাঁর মৃত্যুর পর নতুন পোপ নির্বাচনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। শতাব্দী প্রাচীন এক রীতিনীতির ভিত্তিতেই এই নির্বাচন সম্পন্ন হবে।

পোপের মৃত্যুর পর কী করা হয়?

পোপের মৃত্যুর পর তাঁর শেষকৃত্য কিছু নির্দিষ্ট নীতি ও ঐতিহ্য অনুসরণ করে সম্পন্ন করা হয়। এই প্রক্রিয়াটি ঐতিহাসিকভাবে খুব জটিল। তবে, জীবিত অবস্থায়ই পোপ ফ্রান্সিস তাঁর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার প্রক্রিয়া সহজ ও সংক্ষিপ্ত করার অনুমোদন দিয়েছিলেন।

পূর্ববর্তী পোপদের সাইপ্রেস কাঠ, ওক কাঠ এবং সীসা দিয়ে তৈরি কফিনে সমাহিত করা হতো। কিন্তু ফ্রান্সিস বেছে নিয়েছেন দস্তা-আবৃত সাধারণ কাঠের কফিন। আগে, পোপের মরদেহ সেন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকার ভেতরে ‘ক্যাটাফাল্ক’ নামে এক উঁচু প্ল্যাটফর্মে সর্বসাধারণের দেখার জন্য রাখা হতো।

এই প্রথা ভেঙে, ফ্রান্সিস নির্দেশ দিয়েছিলেন যেন তাঁর দেহ কফিনের ভেতরেই রাখা হয় কিন্তু ঢাকনা খোলা থাকে, যাতে মানুষ সহজেই শ্রদ্ধা জানাতে পারেন।

নতুন পোপ নির্বাচন করা হবে যেভাবে

পোপদের সাধারণত সেন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকাতেই সমাহিত করা হয়। কিন্তু ফ্রান্সিস হতে যাচ্ছেন এক শতাব্দীরও বেশি সময়ের মধ্যে প্রথম পোপ যাঁকে ভ্যাটিকানের বাইরে সমাহিত করা হবে। তাঁর ইচ্ছা অনুযায়ী, তাঁকে রোমের একটি প্রধান গির্জা সেন্ট মারি মেজর ব্যাসিলিকায় সমাহিত করা হবে।

‘ব্যাসিলিকা’ এমন এক ধরনের গির্জা, যাকে ভ্যাটিকান বিশেষ মর্যাদা প্রদান করে। এই মেজর ব্যাসিলিকার সঙ্গে পোপ ফ্রান্সিসের একটি ব্যক্তিগত সংযোগ ছিল।

নতুন পোপ নির্বাচন করেন কারা? নতুন পোপ নির্বাচন করা হবে যেভাবে ?

নতুন পোপ নির্বাচনের দায়িত্ব পালন করেন ক্যাথলিক চার্চের শীর্ষ ধর্মযাজকরা, যাঁরা ‘কলেজ অব কার্ডিনালস’ নামে পরিচিত। এঁরা সকলেই পুরুষ এবং প্রত্যেকে পোপ কর্তৃক নিযুক্ত বিশপ।

বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে মোট ২৫২ জন কার্ডিনাল রয়েছেন। এর মধ্যে ১৩৫ জন নতুন পোপ নির্বাচনে ভোট দেওয়ার যোগ্য। বাকিরা বয়স ৮০ বছরের বেশি হওয়ায় তারা ভোটে অংশ নিতে পারেন না। তবে তাঁরা মতামত দিয়ে আলোচনায় অংশ নিতে পারেন।

নতুন পোপ নির্বাচনের প্রক্রিয়া কেমন?

যখন কোনো পোপ মারা যান (বা, ২০১৩ সালে পোপ বেনেডিক্ট ষোড়শের মতো কেউ পদত্যাগ করেন), তখন ভ্যাটিকানে একটি বিশেষ সভা আহ্বান করা হয়। এই সভা ‘কনক্লেভ’ নামে পরিচিত, যা নতুন পোপ নির্বাচনের প্রক্রিয়ার কেন্দ্রবিন্দু।

পোপের মৃত্যু থেকে শুরু করে নতুন পোপ নির্বাচিত না হওয়া পর্যন্ত, চার্চের সকল কার্যক্রম পরিচালনার দায়িত্ব থাকে ‘কলেজ অব কার্ডিনালস’-এর ওপর।

এই ভোট গ্রহণ চলে বিখ্যাত সিস্টিন চ্যাপেলের ভিতরে, যা চিত্রশিল্পী মাইকেলেঞ্জেলোর আঁকা চিত্রকর্মের জন্য প্রসিদ্ধ। সেখানে কঠোর গোপনীয়তা বজায় রেখে কার্ডিনালরা তাঁদের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দেন।

এই প্রক্রিয়া কয়েকদিন ধরে চলতে পারে। অতীতে এক সপ্তাহ কিংবা এক মাস পর্যন্ত ভোট গ্রহণ চলেছে। এমনকি, কনক্লেভ চলাকালে কারো মৃত্যুর নজিরও রয়েছে।

নতুন পোপ নির্বাচনের অগ্রগতি জানার একমাত্র মাধ্যম হলো ধোঁয়া। ভোট শেষে ব্যালট পুড়িয়ে দেওয়া হয় একটি নির্দিষ্ট চুল্লিতে, এবং সেখান থেকে দিনে দু’বার ধোঁয়া নির্গত হয়। কালো ধোঁয়া মানে পোপ এখনও নির্বাচিত হননি, আর সাদা ধোঁয়া মানে হলো নতুন পোপ নির্বাচিত হয়েছেন।

নতুন পোপের ঘোষণা হয় যেভাবে

সাদা ধোঁয়া দেখা দেওয়ার পর সাধারণত এক ঘণ্টার মধ্যে নতুন পোপ ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরে সেন্ট পিটার্স স্কয়ারের বারান্দায় এসে দাঁড়ান। সেখানে একজন জ্যেষ্ঠ কার্ডিনাল ল্যাটিন ভাষায় ঘোষণা দেন: “হ্যাবেমাস পাপাম”, যার অর্থ—”আমাদের একজন পোপ আছেন।”

এরপর তিনি নতুন পোপের নাম ঘোষণা করেন। এই নাম হতে পারে তাঁর আসল নাম, আবার নাও হতে পারে। যেমন—ফ্রান্সিস নামটি নেওয়ার আগে পোপ ফ্রান্সিসের প্রকৃত নাম ছিল জর্জ মারিও বার্গোগলিও। তিনি ত্রয়োদশ শতাব্দীর ধর্মপ্রচারক ও প্রাণীপ্রেমিক অ্যাসিসির সেন্ট ফ্রান্সিসের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে নিজের নতুন নাম বেছে নেন।

গত এক যুগ ধরে তিনি এই নামেই বিশ্বজুড়ে পরিচিত ছিলেন।

ভূমিকম্পের নীচে লুকিয়ে থাকা রহস্য: চট্টগ্রামে ক্রমাগত ভূমিকম্প কেন?

পোপ হওয়ার যোগ্যতা কী?

তাত্ত্বিকভাবে, যে কোনো বাপ্তিস্ম নেওয়া রোমান ক্যাথলিক পুরুষই পোপ হতে পারেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো, কার্ডিনালরা সাধারণত নিজেদের মধ্য থেকেই একজনকে নির্বাচন করেন।

২০১৩ সালে আর্জেন্টিনার জন্ম নেওয়া জর্জ মারিও বার্গোগলিও, যিনি পরে পোপ ফ্রান্সিস হন, তিনিই দক্ষিণ আমেরিকা থেকে আসা প্রথম পোপ। এই অঞ্চলে বিশ্বের প্রায় ২৮ শতাংশ ক্যাথলিক খ্রিষ্টান বাস করেন।

তবে ইতিহাসে দেখা যায়, বেশিরভাগ সময়ই ইউরোপীয়, বিশেষ করে ইতালীয় কাউকেই পোপ হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে। এখন পর্যন্ত ২৬৬ জন পোপের মধ্যে ২১৭ জনই ছিলেন ইতালিয়ান।

পোপের দায়িত্ব কী?

পোপ হলেন ক্যাথলিক খ্রিষ্টানদের প্রধান ধর্মগুরু। রোমান ক্যাথলিকদের বিশ্বাস, তিনি যীশু খ্রিস্টের প্রতিনিধি এবং সেন্ট পিটারের জীবন্ত উত্তরসূরি।

সেন্ট পিটার ছিলেন যীশু খ্রিস্টের ঘনিষ্ঠ শিষ্যদের অন্যতম এবং খ্রিস্টান ধর্মপ্রচারকদের নেতা। তাই তাঁর উত্তরসূরি হিসেবে একজন পোপ গির্জার প্রধান আধ্যাত্মিক নেতা হিসেবে বিবেচিত হন।

বিশ্বব্যাপী প্রায় ১৪০ কোটির বেশি ক্যাথলিক তাঁর নির্দেশনা অনুযায়ী ধর্মীয় রীতি-নীতি পালন করে থাকেন। সাধারণভাবে খ্রিষ্টানরা বাইবেলের শিক্ষার অনুসরণে জীবনযাপন করে, এবং পোপ তাঁদের কাছে ধর্মীয় দিকনির্দেশনা দেন।

বিশ্বব্যাপী খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের প্রায় অর্ধেক হলেন রোমান ক্যাথলিক। প্রোটেস্ট্যান্ট, অর্থোডক্সসহ অন্যান্য খ্রিষ্টান সম্প্রদায় পোপের কর্তৃত্ব স্বীকার করেন না।

পোপের বাসস্থান বিশ্বের সবচেয়ে ছোট স্বাধীন রাষ্ট্র ভ্যাটিকান সিটিতে, যা ইতালির রাজধানী রোমের মধ্যেই অবস্থিত। পোপ আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো বেতন গ্রহণ করেন না, তবে তাঁর সমস্ত প্রয়োজনীয় ব্যয়ভার বহন করে ভ্যাটিকান সিটি।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।