পৃথিবীর প্রথম সংবিধান কে রচনা করেন? | ইতিহাসের পাতায় সংবিধানের সূচনার গল্প

🌍 পৃথিবীর প্রথম সংবিধান কে রচনা করেন?

আপনি যখন একটি দেশের নাম শুনেন, তখন কি আপনার মনে প্রশ্ন জাগে—এই দেশ কীভাবে চলে? কারা এই রাষ্ট্র পরিচালনার নিয়ম বানায়? আর সেই নিয়মই বা কে ঠিক করে?

সংবিধান মানে শুধু আইন-কানুনের বই নয়—এটি একটি রাষ্ট্রের আত্মা। কিন্তু আপনি কি কখনও ভেবেছেন, পৃথিবীর প্রথম সংবিধান কে রচনা করেন? ইতিহাস বলছে, সংবিধানের ধারণা প্রাচীনকাল থেকেই মানুষের সমাজে ছিল। হোক সেটা পারসিক সম্রাট সাইরাস দ্য গ্রেটের ‘Cyrus Cylinder’, বা ভারতের মনুসংহিতা, কিংবা গ্রীকদের সোলনের আইন—সবই পৃথিবীর প্রথম সংবিধানের দৌড়ে আছে। এই লেখায় আমরা খুঁজে দেখব সংবিধানের সূচনা কোথা থেকে এবং কে প্রথম এই ধারণাটিকে লিখিত রূপ দিয়েছিলেন।

সংবিধান একটি দেশের প্রাণ। এটি শুধু আইনের বই নয়, এটি একটি জাতির মূল্যবোধ, স্বপ্ন ও ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা। একটি দেশের সংবিধান যেমন তার নাগরিকদের অধিকার রক্ষা করে, তেমনি রাষ্ট্রের দায়িত্ব ও কর্তব্যও নির্ধারণ করে দেয়।

কিন্তু, আপনি কি জানেন – এই ‘সংবিধান’ ধারণার সূচনা কোথা থেকে?
কে প্রথম লিখে ফেলেছিলেন এমন একটি দলিল, যা নির্দিষ্ট করেছিল, কীভাবে শাসন চলবে, কীভাবে মানুষকে মর্যাদা দেওয়া হবে?

পৃথিবীর প্রথম সংবিধান

এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে আমাদের পেছনে ফিরতে হয় কয়েক হাজার বছর আগের ইতিহাসে। ইতিহাসের গোপন পাতায় খুঁজে পাওয়া যায় এমন এক শাসকের নাম, যিনি শুধু যুদ্ধজয়ী ছিলেন না, ছিলেন মানবাধিকার রক্ষার এক অগ্রদূত।

আজ আমরা জানব –
পৃথিবীর প্রথম সংবিধান কে রচনা করেন?”
এই প্রশ্নের উত্তর যেমন ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি আমাদের মূল্যবোধ ও সভ্যতার অগ্রগতির দিকেও এক নজর দেওয়ার সুযোগ।

এই লেখায় আপনি জানবেন—

  • সংবিধানের মূল অর্থ ও প্রয়োজনীয়তা
  • প্রাচীন পৃথিবীর আইনের শুরু
  • কে রচনা করেছিলেন পৃথিবীর সর্বপ্রথম সংবিধান
  • এবং সেই সংবিধান কীভাবে আজকের মানবাধিকার ও রাষ্ট্রব্যবস্থার ভিত তৈরি করেছে

আপনি যদি ইতিহাস ভালোবাসেন, কিংবা জানতে চান আমাদের আজকের সভ্যতা কোন ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে আছে, তবে এই লেখাটি আপনার জন্য।

চলুন, একসাথে ফিরে যাই হাজার বছরের পুরোনো এক গল্পে, যেখানে জন্ম নিয়েছিল ‘সংবিধান’ নামের এক মহান ধারণা।

🟢 সংবিধানের সংজ্ঞা বৈশিষ্ট্য

সংবিধান হলো একটি দেশের সর্বোচ্চ আইনগত দলিল, যা রাষ্ট্রের কাঠামো, শাসনব্যবস্থা এবং নাগরিকদের অধিকার ও দায়িত্ব নির্ধারণ করে। এটি শুধু একটি বই নয়, বরং একটি জাতির চিন্তা, নীতি ও মূল্যবোধের লিখিত প্রতিচ্ছবি।

সংবিধানের সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট্য

সংবিধানের মাধ্যমে নির্ধারিত হয় সরকার কিভাবে চলবে, আইন কিভাবে গঠিত হবে, বিচারব্যবস্থা কতটা স্বাধীন থাকবে, এবং সাধারণ নাগরিক কী ধরনের স্বাধীনতা ও সুরক্ষা পাবে। সাধারণত সংবিধান দুই ধরণের হতে পারে—লিখিত ও অলিখিত। যেমন বাংলাদেশের মতো দেশের একটি লিখিত সংবিধান রয়েছে, যা স্পষ্ট ও নির্দিষ্টভাবে আইন ব্যাখ্যা করে; অন্যদিকে যুক্তরাজ্যের মতো দেশে রয়েছে অলিখিত সংবিধান, যা ইতিহাস, প্রথা এবং আদালতের সিদ্ধান্তের মাধ্যমে গঠিত। একটি কার্যকর সংবিধান রাষ্ট্র পরিচালনার সঠিক নীতিমালা নির্ধারণ করে, যেখানে ক্ষমতার ভারসাম্য, নাগরিক অধিকার, এবং ন্যায়বিচারের নিশ্চয়তা দেওয়া হয়। সংবিধান শুধুমাত্র আইনের কথা বলে না, এটি আমাদের বলে দেয় আমরা কেমন রাষ্ট্র চাই—ন্যায়ভিত্তিক, গণতান্ত্রিক ও মানবিক।

📜 পৃথিবীর প্রথম সংবিধানের পূর্ববর্তী শাসনব্যবস্থা

আমরা যদি সংবিধানের ইতিহাস খুঁজতে যাই, তাহলে আমাদের ফিরে তাকাতে হবে কয়েক হাজার বছরের প্রাচীন সভ্যতার দিকে—যেখানে মানুষ প্রথমবারের মতো সমাজবদ্ধ হয়ে বসবাস করতে শিখেছিল। মেসোপটেমিয়া, মিশর এবং সিন্ধু সভ্যতার মানুষ শুধু কৃষিকাজ বা স্থাপত্যেই নয়, শাসনব্যবস্থাতেও অসাধারণ দক্ষতা দেখিয়েছিল। রাজারা তখন একাধারে ধর্মীয় নেতা ও রাজনৈতিক শাসক ছিলেন। তবে শাসনের নিয়ম ছিল অনেকটাই রাজাভিত্তিক—যেখানে ‘রাজা যা বলবে সেটাই আইন’। কিন্তু এই পরিস্থিতির মধ্যেই এক বিপ্লব ঘটে প্রাচীন ব্যাবিলনিয় সভ্যতায়, যখন খ্রিস্টপূর্ব ১৭৫৪ সালে রাজা হেমুরাবি প্রণয়ন করেন ‘হেমুরাবির বিধি’ (Code of Hammurabi)—যা পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন লিখিত আইন। পাথরের ফলকে খোদাই করা এই আইনকানুনে ছিল সমাজের ন্যায়বিচার, শাস্তির পরিমাণ, সম্পত্তির অধিকার, ব্যবসা, বিবাহ ও পারিবারিক সম্পর্ক সংক্রান্ত নির্দেশনা। হেমুরাবির এই পদক্ষেপ ছিল সেই সময়ের জন্য বিপ্লবাত্মক, কারণ এটিই প্রথমবারের মতো সমাজের সকল শ্রেণির জন্য একই আইন প্রবর্তন করেছিল। বলা যায়, এখান থেকেই শুরু হয় নিয়মতান্ত্রিক শাসনের ধারণা, যা পরবর্তীতে ‘সংবিধান’ রূপে বিকশিত হয়।

🟢 মাহফুজনামা – পৃথিবীর প্রথম সংবিধান?

প্রাচীন পারস্যের সম্রাট সাইরাস দ্য গ্রেট ছিলেন এমন একজন শাসক, যিনি শুধু যুদ্ধজয়ের জন্য নয়, বরং মানবাধিকারের প্রতিষ্ঠার জন্য ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন। খ্রিস্টপূর্ব ৫৩৯ সালে, ব্যাবিলন জয়ের পর তিনি তৈরি করলেন একটি অনন্য দলিল, যা আজ বিশ্ববাসীর কাছে পরিচিত সাইরাস সিলিন্ডার (Cyrus Cylinder) নামে। পুড়ানো মাটির তৈরি এই সিলিন্ডারে খোদাই করা ছিল এমন সব নীতিমালা, যা শুধু সেই সময়েই নয়, আজকের দিনেও অত্যন্ত প্রগতিশীল বলে বিবেচিত। এতে বলা হয়েছিল—দাসপ্রথা নিষিদ্ধ থাকবে, প্রত্যেক মানুষ তার ইচ্ছেমতো ধর্ম পালন করতে পারবে, এবং কোনো জাতিগোষ্ঠীকে জোর করে শাসন করা যাবে না। এ যেন আজকের আধুনিক সংবিধানের মানবিক দৃষ্টিভঙ্গিরই প্রাচীন প্রতিচ্ছবি। অনেক ইতিহাসবিদ এবং জাতিসংঘের মতো সংস্থাও সাইরাস সিলিন্ডারকে পৃথিবীর প্রথম মানবাধিকার দলিল এবং সম্ভবত প্রথম লিখিত সংবিধান হিসেবে অভিহিত করেছেন। কিছু গবেষক এটিকে “মাহফুজনামা” নামে উল্লেখ করেন, যার অর্থ—সংরক্ষিত নীতিমালা। এই প্রাচীন দলিলটি কেবল পারস্য সাম্রাজ্যের প্রশাসনিক কাঠামো গড়েই থেমে থাকেনি, বরং গোটা সভ্যতাকে শিখিয়েছিল—শাসন মানে শক্তির ব্যবহার নয়, বরং ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা। তাই একে অনেকেই পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম সংবিধান বলেই স্বীকৃতি দেন।

🟢 অল্টারনেটিভ দাবিগুলো

পৃথিবীর প্রথম সংবিধান নিয়ে মতভেদ অনেক পুরনো। ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন সভ্যতা নিজস্ব আইনকানুন ও শাসনব্যবস্থা প্রণয়ন করেছিল, যেগুলো অনেকক্ষেত্রেই “সংবিধান” শব্দটির আদিম রূপ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। যেমন, প্রাচীন গ্রীসের সোলনের আইন (Solonian Constitution) খ্রিস্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতকে অ্যাথেন্স শহরের জন্য গৃহীত হয়েছিল। সোলন ছিলেন একজন জ্ঞানী রাজনীতিবিদ ও কবি, যিনি দাসত্ব প্রথার বিরুদ্ধে, সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে আইন প্রণয়ন করেন। তার প্রণীত আইনগুলো ছিল গণতান্ত্রিক ধারণার সূচনা, যেখানে সাধারণ জনগণের মতামত এবং অংশগ্রহণকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। অনেকেই বলেন, এই আইনই গ্রীক গণতন্ত্রের বীজ রোপণ করেছিল।

অন্যদিকে, প্রাচীন ভারতের মনুসংহিতা (Manusmriti) বা মনুর বিধান গ্রন্থ একটি বিশাল সামাজিক ও ধর্মীয় আইনগ্রন্থ, যেখানে ব্যক্তির ধর্মীয় কর্তব্য, সামাজিক শ্রেণিবিন্যাস, অপরাধ ও শাস্তি, নারী-পুরুষ সম্পর্ক ও রাজধর্ম সংক্রান্ত নিয়মাবলি বিশদভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। যদিও এটি ধর্মীয় চরিত্রের, তবে এর ভিতরে এমন এক সামাজিক কাঠামো গড়ে তোলা হয়েছিল, যা হাজার বছরের সমাজ পরিচালনার ভিত্তি হিসেবে কাজ করেছে। তাই কেউ কেউ একে একটি ‘ধর্মভিত্তিক সংবিধান’ বলেই আখ্যা দেন।

এছাড়াও, প্রাচীন রোমান রিপাবলিকের Twelve Tables ছিল খ্রিস্টপূর্ব ৪৫০ সালের দিকে গৃহীত একটি গুরুত্বপূর্ণ আইন সংকলন, যা রোমান নাগরিকদের জন্য প্রথম লিখিত ও প্রকাশ্য আইনি কাঠামো তৈরি করে। এই টেবিলগুলোতে পারিবারিক আইন, সম্পত্তি, অপরাধ, দেনাপাওনা এবং নাগরিক অধিকার সংক্রান্ত বিষয়াবলি স্পষ্টভাবে উল্লেখ ছিল। Twelve Tables-এর বৈশিষ্ট্য ছিল এটি সকলের জন্য উপলভ্য এবং প্রকাশ্য, যাতে ধনী-গরিব নির্বিশেষে প্রত্যেক নাগরিক আইনের অধীন থাকে। এটি পশ্চিমা আইনব্যবস্থার মূল ভিত্তিগুলোর অন্যতম বলে বিবেচিত।

এই সকল উদাহরণ থেকে আমরা বুঝতে পারি, পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে বিভিন্ন সভ্যতা তাদের নিজস্ব সময় ও সংস্কৃতির আলোকে আইন ও শাসনের কাঠামো গড়ে তুলেছিল। তাই কারা প্রথম সংবিধান রচনা করেছে তা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও, এই বিকল্প দাবিগুলো আমাদের একটি ব্যাপারে একমত করে—মানব সভ্যতা শুরু থেকেই আইন ন্যায়ের সন্ধানে ছিল

🟢 Cyrus Cylinder বনাম আধুনিক সংবিধান

প্রাচীন Cyrus Cylinder এবং আধুনিক সংবিধানের মধ্যে কিছু মৌলিক মিল এবং স্বতন্ত্র পার্থক্য রয়েছে, যা আমাদেরকে শাসনব্যবস্থা ও মানবাধিকারের বিকাশের একটি পূর্ণাঙ্গ চিত্র উপস্থাপন করে। সাইরাস সিলিন্ডার, যা প্রায় খ্রিস্টপূর্ব ৫৩৯ সালে তৈরি হয়েছিল, এক ধরনের প্রাচীন মাটির সিলিন্ডার যেখানে পারসিক সম্রাট সাইরাস দ্য গ্রেট তার শাসনাধীনে আনার সাম্রাজ্যের মানুষের অধিকার ও ধর্মীয় স্বাধীনতার কথা লিখেছিলেন। এই দলিলটি মূলত একটি শাসন নীতিমালা হিসেবে কাজ করত, যেখানে দাসপ্রথা নিষিদ্ধ, বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর অধিকার সুরক্ষা এবং ধর্মীয় সহিষ্ণুতা প্রতিষ্ঠার বিষয়গুলো স্পষ্টভাবে উল্লেখ ছিল। এটি ছিল মানবাধিকারের খুব প্রাথমিক কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ স্বীকৃতি, যা সাম্রাজ্যের শান্তি ও স্থিতিশীলতা রক্ষায় সাহায্য করেছিল।

অপরদিকে, আধুনিক সংবিধান যেমন ভারত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা অন্যান্য গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সংবিধান, তা অনেক বেশি বিস্তৃত ও ব্যাপক। আধুনিক সংবিধান শুধুমাত্র নাগরিকের মৌলিক অধিকার নির্ধারণ করে না, বরং রাষ্ট্রের প্রশাসনিক কাঠামো, বিচার বিভাগ, আইন প্রণয়ন প্রক্রিয়া, সরকারের শাখাগুলোর ক্ষমতা ও কর্তব্য, নাগরিক দায়িত্ব, এবং সংবিধানের অধীনে শক্তি সীমাবদ্ধকরণের বিষয়গুলোও সুস্পষ্টভাবে নির্দেশ করে। আধুনিক সংবিধান আইনগতভাবে বাধ্যতামূলক এবং রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ ও নাগরিক উভয়ের জন্য বাধ্যবাধকতা আরোপ করে। এটি সংশোধনের সুযোগ রাখে, যা সময়ের প্রয়োজন ও সমাজের পরিবর্তনের সাথে মানিয়ে নেওয়ার সুযোগ দেয়।

আরও গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য হলো—Cyrus Cylinder মূলত একটি শাসকের দপ্তরীয় ঘোষণা বা নীতিমালা, যা একটি নির্দিষ্ট সময় ও এলাকায় প্রযোজ্য ছিল। যেখানে আধুনিক সংবিধান সাধারণত গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে গৃহীত হয় এবং সারা রাষ্ট্রে সমানভাবে প্রযোজ্য থাকে। আধুনিক সংবিধানে শক্তি বিভাজনের ধারণা যেমন নির্বাহী, আইনসভা ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়, যা Tyranny বা একনায়কত্ব থেকে রক্ষা করে। তবে সাইরাস সিলিন্ডারের নীতিগুলো ছিল সেই যুগের জন্য অসাধারণ প্রগতিশীল, কারণ এটি একটি বিরল সময়ে মানুষের মৌলিক স্বাধীনতার কথা তুলে ধরেছিল।

সুতরাং, সাইরাস সিলিন্ডারকে ‘প্রথম সংবিধান’ বা ‘প্রথম মানবাধিকার ঘোষণা’ হিসেবে বিবেচনা করলেও আধুনিক সংবিধান হলো সেই প্রাচীন ধারণার বিকাশ ও পরিণতি, যা যুগের পর যুগে মানুষ কর্তৃক উন্নত ও রূপান্তরিত হয়েছে। এটি কেবল আইন নয়, বরং একটি জাতির চেতনা, মূল্যবোধ ও স্বপ্নের প্রতীক, যা সকল নাগরিকের জন্য সাম্যের ভিত্তি গড়ে তোলে।

freepik the style is candid image photography with natural 8062 পৃথিবীর প্রথম সংবিধান কে রচনা করেন? | ইতিহাসের পাতায় সংবিধানের সূচনার গল্প

🟢 পৃথিবীর আধুনিক সংবিধানের যাত্রা

আধুনিক বিশ্বের সংবিধানের ইতিহাস শুরু হয় মূলত ১৭৮৭ সালে, যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান প্রণীত হয়। এটি ছিল বিশ্বের প্রথম আধুনিক গণতান্ত্রিক সংবিধান, যা শুধুমাত্র একটি লিখিত দলিলই নয়, বরং শাসনব্যবস্থার মৌলিক কাঠামো, ক্ষমতার বিভাজন এবং নাগরিক অধিকার সংরক্ষণের ভিত্তি স্থাপন করেছিল। মার্কিন সংবিধান বিশ্বের ইতিহাসে গণতন্ত্রের যাত্রাকে এক নতুন মাত্রা দিয়েছিল, যেখানে জনগণের ভোটাধিকার, আইনসভা ও নির্বাহী শাখার ক্ষমতার ভারসাম্য, এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়। এটি আধুনিক রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য একটি মডেল হিসেবে বিবেচিত হয়েছে এবং অনেক দেশের সংবিধান প্রণয়নের পথপ্রদর্শক হয়েছে।

তবে মার্কিন সংবিধানের এই জয়যাত্রায় ফরাসি বিপ্লবেরও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। ১৭৮৯ সালে ফ্রান্সে শুরু হওয়া ফরাসি বিপ্লব শুধুমাত্র একটি রাজনৈতিক আন্দোলন ছিল না, এটি মানবাধিকার ও সমতার এক মহান বার্তা বহন করেছিল। ফরাসি বিপ্লবের ঘোষণা, বিশেষ করে “Declaration of the Rights of Man and of the Citizen,” মানবাধিকার, স্বাধীনতা এবং ন্যায়বিচারের নীতিগুলোকে বিশ্বমঞ্চে প্রতিষ্ঠিত করেছিল। এই বিপ্লবের প্রভাব সারা ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে এবং আধুনিক সংবিধান রচনার ক্ষেত্রে মানুষের মৌলিক অধিকার ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের গুরুত্ব বহুগুণ বৃদ্ধি পায়।

জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া: জাপানের নিপীড়নে কোরিয়ার কান্না ও প্রতিরোধ

এই দুই ঘটনাই আধুনিক সংবিধানের ইতিহাসে মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত, যেগুলো শাসনব্যবস্থার স্বচ্ছতা, মানুষের অধিকার সংরক্ষণ এবং গণতান্ত্রিক শাসনের শক্ত ভিত্তি গড়ে তুলেছে। তাই বলা যায়, আধুনিক সংবিধান হচ্ছে সেই প্রাচীন আইনি ও সামাজিক ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা, যা মানুষের স্বাধীনতা ও ন্যায়বিচারের আকাঙ্ক্ষাকে রূপদান করেছে।

১. সাইরাস সিলিন্ডার এখন কোথায় আছে?
সাইরাস সিলিন্ডার বর্তমানে যুক্তরাজ্যের লন্ডনের ব্রিটিশ মিউজিয়ামে সংরক্ষিত আছে। এটি একটি অত্যন্ত মূল্যবান ঐতিহাসিক নিদর্শন হিসেবে বিশ্বব্যাপী পরিচিত, যা প্রাচীন পারসিক সভ্যতার মানবাধিকার চেতনার প্রমাণ হিসেবে গন্য হয়।

২. এটি কোন ভাষায় লেখা ছিল?
সাইরাস সিলিন্ডারে লেখা ছিল অ্যাকাডিয়ান ভাষায়, যা মেসোপটেমিয়ার প্রাচীন কূর্দ ভাষার একটি প্রাচীন রূপ। সেই সময়ের প্রশাসনিক ভাষা হিসেবে এটি ব্যবহৃত হত এবং মাটির সিলিন্ডারে ক্লেয়ার খোদাই করা হত।

৩. আধুনিক কোনো সংবিধানে এর প্রভাব আছে কি?
অবশ্যই আছে। সাইরাস সিলিন্ডারকে প্রাচীনকালে মানবাধিকারের প্রথম রূপ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আধুনিক সংবিধানগুলোতে যেমন নাগরিক অধিকার, ধর্মীয় স্বাধীনতা এবং দাসপ্রথার অবসানের নীতিগুলো গুরুত্বপূর্ণ অংশ, তার প্রভাব সাইরাস সিলিন্ডারের মতো প্রাচীন নীতির ধারাবাহিকতা হিসেবে দেখা যায়। বিশেষ করে, মার্কিন ও ফরাসি সংবিধান মানবাধিকার ও স্বাধীনতার গুরুত্ব দিতে গিয়ে এই প্রাচীন ঐতিহ্য থেকে অনুপ্রেরণা নিয়েছে।

আজ আমরা জানতে পারলাম, পৃথিবীর প্রথম সংবিধান কে রচনা করেন, এ নিয়ে বিতর্ক থাকলেও সাইরাস সিলিন্ডার একটি ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত।

সংবিধান কেবল একটি আইন বা দলিল নয়, এটি একটি জাতির আত্মা, তার সভ্যতা ও মানবাধিকার চেতনার প্রতীক। পৃথিবীর প্রথম সংবিধান কে রচনা করেছিলেন—এই প্রশ্নের উত্তর এককথায় বলা কঠিন, কারণ মানবসভ্যতার নানা প্রাচীন সংস্কৃতিতে শাসনব্যবস্থা ও আইনের প্রাথমিক ধারণাগুলো বহুলভাবে বিদ্যমান ছিল। তবে পারসিক সম্রাট সাইরাস দ্য গ্রেটের “Cyrus Cylinder” আজকের দৃষ্টিকোণ থেকে যদি দেখা হয়, তা পৃথিবীর প্রথম লিখিত সংবিধান হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। কারণ এতে মানবাধিকারের স্বীকৃতি, ধর্মীয় স্বাধীনতা এবং শাসকের ন্যায়নিষ্ঠার বিষয়গুলো স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে, যা এক যুগান্তকারী দৃষ্টিভঙ্গি ছিল।

তবে আধুনিক সংবিধানসমূহ সেই প্রাচীন নীতিগুলোর উপর ভিত্তি করে আরও বিস্তৃত, সংগঠিত ও গণতান্ত্রিক রূপ নিয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান থেকে শুরু করে ফরাসি বিপ্লবের মানবাধিকার ঘোষণাপত্র পর্যন্ত, সবকিছুই সেই প্রাচীন ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা। আজকের দিনে সংবিধান হচ্ছে মানুষের স্বাধীনতা, সাম্য ও ন্যায়বিচারের গ্যারান্টি, যা মানবসমাজের উন্নতির মূল চালিকাশক্তি।

অতএব, সাইরাস সিলিন্ডার আমাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেয় যে, মানবাধিকার ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই বহু প্রাচীন। এটি আমাদের শেখায় কিভাবে মানব সমাজ যুগে যুগে সংবিধান রচনা করে তার মূল্যবোধ ও নীতিগুলো রক্ষা করেছে এবং ভবিষ্যতের জন্য স্থির করেছে একটি শান্তিপূর্ণ ও সমতাবান সমাজ গড়ার পথ। তাই আজকের আধুনিক সংবিধানগুলো সেই প্রথম সংবিধানের ধারাবাহিক উত্তরসূরী, যা পৃথিবীর মানুষের জীবনে অমোঘ প্রভাব ফেলে চলেছে।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।