ফিলিস্তিনের সেনাবাহিনী নেই—এটি একটি প্রশ্ন যা বেশিরভাগ মানুষের মনে আসে, বিশেষ করে আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং যুদ্ধের কৌশল নিয়ে আলোচনা করার সময়। ফিলিস্তিন একটি অঞ্চল যা দীর্ঘকাল ধরে যুদ্ধ, সংঘর্ষ এবং রাজনৈতিক সমস্যার মধ্যে রয়েছে। তবে, এখানকার সেনাবাহিনী না থাকা কেন গুরুত্বপূর্ণ? এই প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে আমাদের ফিলিস্তিনের ইতিহাস, রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং এর সশস্ত্র বাহিনীর গঠন সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে জানার প্রয়োজন।

Table of Contents
ফিলিস্তিনের ইতিহাস: কিভাবে শুরু হয়েছিল?
ফিলিস্তিনের বর্তমান পরিস্থিতি বুঝতে হলে, আমাদের ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকাতে হবে। ফিলিস্তিন ভূখণ্ডের ইতিহাস বেশ পুরানো, এবং এটি দীর্ঘকাল ধরে বিভিন্ন সাম্রাজ্যের অধীনে ছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর, ব্রিটিশ সাম্রাজ্য এই অঞ্চলকে ‘ব্রিটিশ ম্যান্ডেট’ হিসেবে নিয়ন্ত্রণ করেছিল। ১৯৪৭ সালে জাতিসংঘ প্যালেস্টাইনকে দুইটি রাষ্ট্রে ভাগ করার একটি প্রস্তাব দেয়, যার ফলে একটি নতুন ইহুদি রাষ্ট্র—ইসরায়েল প্রতিষ্ঠিত হয়।
১৯৪৮ সালে, ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে ইসরায়েলের সম্পর্ক সংকটের দিকে চলে যায়। ১৯৬৭ সালে ৬ দিনের যুদ্ধে ইসরায়েল পশ্চিম তীর, গাজা উপকূল এবং পূর্ব জেরুজালেম দখল করে নেয়। এরপর থেকে ফিলিস্তিনিদের জন্য একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের জন্য সংগ্রাম অব্যাহত থাকে।
ফিলিস্তিনের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম
ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথম শুরু ১৯৪৮ সালে, যখন ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। সেই সময় ফিলিস্তিনিরা জাতিগত এবং ধর্মীয় সংঘর্ষের মুখে পড়ে। ইসরায়েলি বাহিনী এবং আরব রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে ব্যাপক যুদ্ধ হয়, যা ‘আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ’ হিসেবে পরিচিত।
ফিলিস্তিন আঞ্চলিক বিভাজন
১৯৬৭ সালে আরেকটি যুদ্ধের পর, ফিলিস্তিনের ভূখণ্ডকে আরেকটি দুঃখজনক পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়। অধিকৃত পশ্চিম তীর এবং গাজা উপত্যকায় ফিলিস্তিনিদের বসবাস আরও কঠিন হয়ে ওঠে। এই সময় থেকেই ফিলিস্তিনের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক ক্ষমতা কমতে থাকে।
ফিলিস্তিনের সেনাবাহিনী নেই কেন?
ফিলিস্তিনের সেনাবাহিনী না থাকার পেছনে মূলত কিছু রাজনৈতিক এবং ভূ-রাজনৈতিক কারণ রয়েছে:
১. আন্তর্জাতিক সম্মতি এবং ইসরায়েলের প্রভাব
ফিলিস্তিনের রাষ্ট্র গঠনের প্রক্রিয়ায় অনেক আন্তর্জাতিক চুক্তি রয়েছে, যেমন ‘অসলো চুক্তি’ (১৯৯৩)। এই চুক্তির মাধ্যমে ইসরায়েল ও প্যালেস্টিনিয়ান অথরিটি (PA) একটি সামরিক বাহিনী তৈরি করার সুযোগ পায়, তবে কিছু শর্তের আওতায়। এর মধ্যে অন্যতম একটি শর্ত ছিল ফিলিস্তিনের একটি পূর্ণাঙ্গ সেনাবাহিনী গঠন না করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া। এটি ছিল ইসরায়েলের নিরাপত্তা শঙ্কা দূর করার জন্য, কারণ ইসরায়েল চাইত না যে ফিলিস্তিনের সেনাবাহিনী তাদের নিরাপত্তার জন্য হুমকি সৃষ্টি করুক।
২. রাজনৈতিক বিভাজন
ফিলিস্তিনের ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি অত্যন্ত জটিল। ২০০৭ সালে, হামাস গাজার শাসনভার গ্রহণ করে এবং পশ্চিম তীরের নিয়ন্ত্রণ পায় ফাতাহ দল। এর ফলে দুটি প্রধান রাজনৈতিক শক্তি—হামাস এবং ফাতাহ—একই সময়ে একে অপরের বিরোধী হয়ে ওঠে। এই রাজনৈতিক বিভাজনও একটি জাতীয় সেনাবাহিনী গঠনের পথে বড় বাধা সৃষ্টি করেছে।
৩. অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা
ফিলিস্তিনের অর্থনীতি অনেকটাই আন্তর্জাতিক সাহায্য এবং দাতা সংস্থার উপর নির্ভরশীল। একটি পূর্ণাঙ্গ সেনাবাহিনী গঠন এবং তার পরিচালনার জন্য বিশাল বাজেট প্রয়োজন, যা ফিলিস্তিন সরকারের জন্য বাস্তবসম্মত নয়। সীমিত সম্পদ এবং আঞ্চলিক সমস্যা ফিলিস্তিনকে পূর্ণাঙ্গ সেনাবাহিনী গঠনের দিকে ধাবিত হতে দেয়নি।
ফিলিস্তিনের সশস্ত্র বাহিনী

যদিও ফিলিস্তিনের কোনো পূর্ণাঙ্গ সেনাবাহিনী নেই, তবুও এখানে কিছু সশস্ত্র বাহিনী রয়েছে, যেগুলি বিভিন্ন ধরনের নিরাপত্তা এবং আক্রমণাত্মক কার্যক্রম পরিচালনা করে। তাদের মধ্যে কিছু প্রধান বাহিনী হল:
১. ফিলিস্তিনের জাতীয় নিরাপত্তা বাহিনী (PNA)
ফিলিস্তিনের জাতীয় নিরাপত্তা বাহিনী বা Palestinian National Security Forces (PNA) ১৯৯৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। এই বাহিনী মূলত ফিলিস্তিনী অঞ্চলে আইন শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য গঠিত হয়েছিল এবং ইসরায়েলের সঙ্গে সংঘর্ষ এড়ানোর চেষ্টা করেছিল। এই বাহিনী তাদের প্রশিক্ষণ এবং অস্ত্র সরবরাহের জন্য আন্তর্জাতিক সহায়তা গ্রহণ করে থাকে।
২. আল কাসাম ব্রিগেড
আল কাসাম ব্রিগেড হল হামাসের সামরিক শাখা, যা গাজা উপকূলে সবচেয়ে শক্তিশালী সশস্ত্র বাহিনী হিসেবে পরিচিত। আল কাসাম ব্রিগেড ইসরায়েলের বিরুদ্ধে বিভিন্ন আক্রমণ চালায় এবং এদের ভূমিকা ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার সংগ্রামে গুরুত্বপূর্ণ। হামাসের প্রতিষ্ঠা এবং ব্রিগেডের গঠন ফিলিস্তিনের রাজনৈতিক এবং সামরিক ভূ-রাজনীতিতে একটি বড় ভূমিকা পালন করে।
৩. অন্যান্য সশস্ত্র বাহিনী
ফিলিস্তিনে আরো কিছু সশস্ত্র বাহিনী রয়েছে, যেমন ইসলামিক জিহাদ, পিপলস গার্ড, এবং অন্যান্য গেরিলা বাহিনী। এই বাহিনীগুলোর অধিকাংশই গাজার মধ্যে সক্রিয়, এবং তাদের উদ্দেশ্য হলো ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া।
কেন আমেরিকা সবসময় মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে জড়ায়?
সামরিক বাহিনীর অভাব এবং তার পরিণতি
ফিলিস্তিনের সেনাবাহিনী না থাকা শুধু এককভাবে ফিলিস্তিনের নিরাপত্তা পরিস্থিতিকে প্রভাবিত করে না, বরং এটি বিশ্ব রাজনীতির উপরও গভীর প্রভাব ফেলে। আন্তর্জাতিকভাবে ফিলিস্তিনের সেনাবাহিনী না থাকার বিষয়টি অনেক সময় আঞ্চলিক এবং বৈশ্বিক শক্তির মধ্যে সমঝোতার একটি বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইসরায়েল এবং অন্যান্য দেশ এই পরিস্থিতি সুবিধাজনক মনে করে, কারণ ফিলিস্তিন কোনো পূর্ণাঙ্গ সেনাবাহিনী গঠন করতে পারলে তা ইসরায়েলের জন্য একটি বড় নিরাপত্তা হুমকি হয়ে উঠতে পারে।
ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
ফিলিস্তিনের সেনাবাহিনী না থাকার প্রধান কারণগুলোর মধ্যে আন্তর্জাতিক রাজনীতি, অর্থনৈতিক সংকট, এবং আঞ্চলিক দ্বন্দ্ব রয়েছে। তবে, ভবিষ্যতে এটি একটি পরিবর্তনশীল বিষয় হতে পারে, বিশেষত যদি কিছু গুরুত্বপূর্ণ উপাদান পরিবর্তিত হয়। এখানে আমরা ফিলিস্তিনের সেনাবাহিনী গঠনের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা এবং এর জন্য সম্ভাব্য পথগুলোর আলোচনা করব।
১. আন্তর্জাতিক সহায়তা এবং সমর্থন
ফিলিস্তিনের সেনাবাহিনী গঠন নিয়ে আন্তর্জাতিক স্তরে যে বাধাগুলো রয়েছে, তা শুধুমাত্র ইসরায়েল বা পশ্চিমি দেশগুলোর পক্ষ থেকে নয়, বরং আঞ্চলিক এবং বৈশ্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতির ওপরও নির্ভরশীল। তবে, গত কয়েক দশক ধরে ফিলিস্তিনের স্বশাসন ও স্বাধীনতা অর্জনের জন্য আন্তর্জাতিক সহায়তা কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা যেমন জাতিসংঘ, আরব লীগ এবং অন্যান্য দেশগুলো ফিলিস্তিনের জন্য রাজনৈতিক ও মানবিক সহায়তা প্রদান করছে।
এছাড়া, যদি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মাঝে ফিলিস্তিনের সেনাবাহিনী গঠনের প্রতি আগ্রহ বা সহানুভূতি বৃদ্ধি পায়, তবে বিভিন্ন আঞ্চলিক শক্তি তাদের সহযোগিতার মাধ্যমে ফিলিস্তিনের সেনাবাহিনী গঠনে সহায়তা করতে পারে। কিছু দেশ, যেমন তুরস্ক, ইরান এবং কাতার, ইতোমধ্যেই ফিলিস্তিনের সংগঠনগুলোকে সমর্থন প্রদান করছে।
২. ফিলিস্তিনের আঞ্চলিক রাজনৈতিক ঐক্য
বর্তমানে ফিলিস্তিনের দুটি প্রধান রাজনৈতিক দল, হামাস এবং ফাতাহ, পশ্চিম তীর এবং গাজায় পৃথকভাবে শাসন করছে। এই বিভাজন ফিলিস্তিনের রাজনৈতিক শক্তিকে দুর্বল করে দিয়েছে এবং সেনাবাহিনী গঠনের সম্ভাবনা ক্ষুণ্ণ করেছে। তবে, ভবিষ্যতে যদি এই দুটি দলের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়, তবে ফিলিস্তিনের সেনাবাহিনী গঠনের পথ সুগম হতে পারে।
এর জন্য ফিলিস্তিনের রাজনৈতিক শক্তিগুলোর মধ্যে বিশ্বাস এবং সংলাপের প্রয়োজন। বিশেষ করে যদি হামাস এবং ফাতাহ একত্রিত হয়ে একটি জাতীয় সংহতি সরকার গঠন করতে পারে, তবে ফিলিস্তিনের সেনাবাহিনী গঠনের ক্ষেত্রে তাদের সমন্বিত দৃষ্টিভঙ্গি এবং সিদ্ধান্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
৩. বিশ্বের অন্যান্য মুসলিম দেশগুলোর ভূমিকা
ফিলিস্তিনের সেনাবাহিনী গঠনে বিশ্বের অন্যান্য মুসলিম দেশগুলোর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আরব রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে ঐক্যপূর্ণ সহায়তা, যেমন তুরস্ক, সৌদি আরব, ইরান এবং কাতারের ভূমিকা, ভবিষ্যতে ফিলিস্তিনের জন্য সহায়ক হতে পারে। এসব দেশ ফিলিস্তিনকে সামরিক প্রশিক্ষণ, অস্ত্র সরবরাহ এবং রাজনৈতিক সমর্থন প্রদান করতে পারে, যা সেনাবাহিনী গঠনের পথে একটি বড় পদক্ষেপ হতে পারে।
৪. ইসরায়েলের অবস্থান এবং শান্তির সম্ভাবনা
ইসরায়েলিরা দীর্ঘকাল ধরে ফিলিস্তিনের সেনাবাহিনী গঠনকে প্রতিহত করে আসছে, কারণ তারা মনে করে যে, এটি তাদের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হতে পারে। তবে, যদি ইসরায়েল এবং ফিলিস্তিনের মধ্যে স্থায়ী শান্তিচুক্তি হতে থাকে, এবং দুই পক্ষের মধ্যে নিরাপত্তা সহযোগিতার পরিবেশ সৃষ্টি হয়, তবে ফিলিস্তিনের সেনাবাহিনী গঠন সম্ভব হতে পারে।
এই প্রক্রিয়া অনেকটাই নির্ভর করে ইসরায়েল এবং ফিলিস্তিনের মধ্যকার আস্থা এবং শান্তির পরিবেশের ওপর। যদি ভবিষ্যতে একটি শান্তি চুক্তি সই হয় এবং এটি দুই পক্ষের জন্য লাভজনক হয়, তাহলে ফিলিস্তিনের সেনাবাহিনী গঠনের জন্য একধরনের পথ উন্মুক্ত হতে পারে।
ফিলিস্তিনের সেনাবাহিনী না থাকার পেছনে বহু কারণ রয়েছে, যার মধ্যে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং ভূ-রাজনৈতিক কারণে অন্যতম। তবে, ফিলিস্তিনের সশস্ত্র বাহিনী—যেমন আল কাসাম ব্রিগেড এবং ফিলিস্তিনের জাতীয় নিরাপত্তা বাহিনী—নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। ফিলিস্তিনের ভবিষ্যত নির্ভর করে একদিকে আন্তর্জাতিক সম্মতি এবং অন্যদিকে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ঐক্যের ওপর, যা এই অঞ্চলের শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য অপরিহার্য।