কেন আমেরিকা সবসময় মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে জড়ায়?

মধ্যপ্রাচ্য বিশ্ব রাজনীতির একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল। এটি কৌশলগত অবস্থান, প্রাকৃতিক সম্পদ এবং ঐতিহাসিক কারণের জন্য দীর্ঘদিন ধরে বিশ্ব পরাশক্তিগুলোর নজরে রয়েছে। বিশেষ করে, যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ধরে সক্রিয়ভাবে জড়িত। কিন্তু কেন? কী কারণে আমেরিকা সবসময় মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক সমীকরণে প্রবেশ করে? এই বিশদ প্রবন্ধে আমরা সেই কারণগুলো বিশ্লেষণ করব।

মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি

১. মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব

১.১ ভৌগোলিক অবস্থান

মধ্যপ্রাচ্য এশিয়া, ইউরোপ এবং আফ্রিকার সংযোগস্থলে অবস্থিত। এটি ইউরোপ ও এশিয়ার মধ্যকার গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য পথগুলোর কেন্দ্রবিন্দু। সুয়েজ খাল, হরমুজ প্রণালী এবং বাব-আল-মান্দেব প্রণালীর মতো জলপথগুলো বিশ্ব বাণিজ্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

এই অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ মানেই বাণিজ্য প্রবাহে প্রভাব বিস্তার করা। ইউরোপ ও এশিয়ার মধ্যে নৌপথের মাধ্যমে বাণিজ্য সহজতর করার জন্য মধ্যপ্রাচ্যের স্থিতিশীলতা এবং প্রভাব বিস্তার করা যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত লক্ষ্য।

মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি

১.২ প্রাকৃতিক সম্পদ

মধ্যপ্রাচ্য পৃথিবীর বৃহত্তম তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসের ভাণ্ডার। সৌদি আরব, ইরাক, ইরান, কুয়েত ও সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ অনেক দেশ প্রচুর পরিমাণে জ্বালানি সম্পদ ধারণ করে। যুক্তরাষ্ট্রের শিল্পোন্নত অর্থনীতি জ্বালানির ওপর নির্ভরশীল, তাই এই অঞ্চলের রাজনীতি তাদের জাতীয় স্বার্থের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।

বিশ্বের তেলের বিশাল অংশ মধ্যপ্রাচ্য থেকে আসে, এবং যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এই অঞ্চলে হস্তক্ষেপ অপরিহার্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।


২. আমেরিকার মধ্যপ্রাচ্যে হস্তক্ষেপের প্রধান কারণ

২.১ তেল এবং শক্তির নিরাপত্তা

বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য জ্বালানি সরবরাহ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৭৩ সালের আরব-ইসরাইল যুদ্ধের পর তেল সংকট দেখা দিলে যুক্তরাষ্ট্র উপলব্ধি করে যে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতির ওপর তাদের প্রভাব থাকা প্রয়োজন।

তেলের মূল উৎপাদক দেশগুলো যদি কখনো যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে অবস্থান নেয়, তবে বিশ্ববাজারে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্ব হুমকির মুখে পড়তে পারে। এই কারণেই আমেরিকা এই অঞ্চলে তার সামরিক ও কূটনৈতিক উপস্থিতি বজায় রাখে।

২.২ ইসরাইলের প্রতি সমর্থন

ইসরাইল যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান মিত্র। ১৯৪৮ সালে রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠার পর থেকে আমেরিকা সবসময় ইসরাইলের পাশে থেকেছে। ইসরাইলকে সামরিক ও অর্থনৈতিক সহায়তা দিয়ে আসছে যুক্তরাষ্ট্র, যা মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে তাদের সরাসরি জড়িত থাকার অন্যতম কারণ।

যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলকে প্রতিরক্ষা সহায়তা প্রদান করে এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চায়। এই কারণে আমেরিকা ফিলিস্তিন সংকটেও সরাসরি হস্তক্ষেপ করে।

কারগিল যুদ্ধ :এক যুদ্ধ, যা বদলে দিয়েছিল কাশ্মীরের ইতিহাস

২.৩ সন্ত্রাসবাদ প্রতিরোধ

২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের সন্ত্রাসী হামলার পর যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যে সামরিক উপস্থিতি আরও বাড়িয়ে দেয়। আল-কায়েদা, আইএস-এর মতো সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে এবং আফগানিস্তান ও ইরাকে সামরিক অভিযান পরিচালনা করে।

যুক্তরাষ্ট্র মনে করে, মধ্যপ্রাচ্যে সন্ত্রাসবাদের উত্থান হলে তা তাদের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। তাই তারা এই অঞ্চলকে নজরদারির মধ্যে রাখতে চায়।

২.৪ রাশিয়া ও চীনের প্রতিযোগিতা

মধ্যপ্রাচ্যে রাশিয়া ও চীনের প্রভাব কমানোর জন্যও যুক্তরাষ্ট্র এখানে সক্রিয় থাকে। সিরিয়া যুদ্ধের সময় রাশিয়া প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদকে সমর্থন করেছিল, যেখানে যুক্তরাষ্ট্র বিদ্রোহীদের সহায়তা করেছিল।

চীন মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সাথে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বাড়াচ্ছে, যা আমেরিকার জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে।

২.৫ অস্ত্র ব্যবসা

মধ্যপ্রাচ্য বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ অস্ত্রবাজার। সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার, কুয়েতসহ বিভিন্ন দেশ যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ক্রয় করে।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা শিল্পের জন্য এই অঞ্চল একটি গুরুত্বপূর্ণ বাজার, যেখানে তারা তাদের অস্ত্র বিক্রি করে এবং অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হয়।

মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি

৩. মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার সামরিক উপস্থিতি

৩.১ ইরাক যুদ্ধ (২০০৩-২০১১)

যুক্তরাষ্ট্র ২০০৩ সালে ইরাকে সামরিক অভিযান পরিচালনা করে, যার প্রধান কারণ হিসেবে বলা হয় যে ইরাক গণবিধ্বংসী অস্ত্র তৈরি করছে। তবে এই যুদ্ধের পেছনে প্রকৃত কারণ ছিল মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার আধিপত্য বজায় রাখা।

এই যুদ্ধের ফলে ইরাকে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয় এবং যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান নিয়ে বিশ্বব্যাপী বিতর্ক শুরু হয়।

৩.২ আফগানিস্তান যুদ্ধ (২০০১-২০২১)

৯/১১ হামলার পর যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে সামরিক অভিযান চালিয়ে তালেবান সরকারকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেয়। তবে ২০ বছর পর ২০২১ সালে যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহার করে নেয়।

৩.৩ সিরিয়া সংকট

সিরিয়া গৃহযুদ্ধে আমেরিকা বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোকে সমর্থন দিলেও রাশিয়া এবং ইরান আসাদের পক্ষে থাকায় এই সংঘাত জটিল হয়ে ওঠে।


৪. বর্তমান পরিস্থিতি

৪.১ ইরান ও পারমাণবিক চুক্তি

যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে পারমাণবিক চুক্তি নিয়ে আলোচনায় টানাপোড়েন চলছে। আমেরিকা ইরানের পারমাণবিক কার্যক্রম সীমিত করতে চাইছে, কিন্তু ইরান তাদের পরমাণু কর্মসূচি অব্যাহত রেখেছে। এতে মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

৪.২ সৌদি আরব ও আমেরিকা

সাম্প্রতিক সময়ে চীনের সঙ্গে সৌদি আরবের ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধি পেয়েছে, যা আমেরিকার জন্য উদ্বেগের কারণ। সৌদি আরব এখন বিকল্প জোট গঠনের চেষ্টা করছে, যা মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে নতুন সমীকরণ তৈরি করতে পারে।

৪.৩ ফিলিস্তিন-ইসরাইল দ্বন্দ্ব

যুক্তরাষ্ট্র সবসময় ইসরাইলের প্রতি সমর্থন দেখিয়েছে, যা মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সঙ্গে তাদের সম্পর্ক জটিল করে তুলেছে। সাম্প্রতিক সময়ে গাজা সংঘাতের ফলে আমেরিকার অবস্থান নিয়ে বিতর্ক আরও বেড়েছে।


যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন ধরে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করছে। তবে বিশ্ব পরিস্থিতি পরিবর্তন হচ্ছে এবং ভবিষ্যতে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা কী হবে, তা সময়ই বলে দেবে।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।